নতুন নামেও টিকে থাকতে পারল না পদ্মা ব্যাংক। সংকটে থাকা এই ব্যাংক শরিয়াহ্ভিত্তিক এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ নিয়ে বেসরকারি খাতের ব্যাংক দুটির মধ্যে আগামী সোমবার একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হবে। দুর্বল ব্যাংক একীভূত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেওয়া সাম্প্রতিক উদ্যোগের পর দুটি ব্যাংকের একীভূত হওয়ার এটিই প্রথম সিদ্ধান্ত।
দেশে ২০১৩ সালে নতুন যে ৯টি ব্যাংক অনুমোদন পায়, তার একটি হলো পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স)। শুরু থেকেই এটির কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ। যেমন অনুমোদন পাওয়ার আগেই ব্যাংকটি অফিস খুলে লোকবল নিয়োগ দিতে শুরু করেছিল। আবার সম্পর্কের ভিত্তিতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানত জমা নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি শুরু করেন এর উদ্যোক্তারা। ফলে চার বছর না পেরোতেই সংকটে পড়ে ব্যাংকটি।
আমাদের পর্ষদ এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা ও পরামর্শ মেনে ঠিক হবে, পরবর্তীতে কী হবে।তারেক রিয়াজ খান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পদ্মা ব্যাংক।
পরিস্থিতির চরম অবনতি হওয়ায় ২০১৭ সালে পদ ছাড়তে বাধ্য হন এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। ব্যাংকটির এমডি এ কে এম শামীমকেও অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন এই ব্যাংককে বাঁচাতে মূলধনসহায়তা দেয় সরকারি চার ব্যাংক ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। সেই সুবাদে ব্যাংকটির পরিচালনায় যুক্ত হন ওই চার ব্যাংক ও আইসিবির প্রতিনিধিরা। পদ্মা ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত।
২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারিতে দ্য ফারমার্স ব্যাংকের নাম বদলে রাখা হয় পদ্মা ব্যাংক। এ রকম অবস্থায় শরীয়াহ্ভিত্তিক এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পদ্মা। এর ফলে ব্যাংকের তালিকা থেকে বাদ পড়তে যাচ্ছে পদ্মা ব্যাংকের নাম।
সাবেক ফারমার্স ব্যাংকে অনিয়মের পর দেশছাড়া হন মহীউদ্দীন খান আলমগীর। আর জেলে আছেন নির্বাহী কমিটির তৎকালীন চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতী এবং তাঁর ছেলে রাশেদুল হক চিশতী। গত বছরের অক্টোবরে ১৬০ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় তাঁদের ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছে।
ফারমার্স ব্যাংক নাম থাকাকালে ব্যাংকটি নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে। নাম পরিবর্তন করে পদ্মা ব্যাংক হওয়ার পর আবার নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে ব্যবহার করে নানা ছাড় নিতে শুরু করে। এতে প্রকৃত ব্যাংকের চরিত্র হারায় ব্যাংকটি। একটি ব্যাংক টিকে থাকার মূল শর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো আমানতের বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাহিদামতো অর্থ ও বন্ড জমা রাখা, সেটিতেও ছাড় দেওয়া হয় ব্যাংকটিকে। ব্যাংকের প্রকৃত চিত্র গোপন করে আর্থিক প্রতিবেদন ভালো দেখানোর সুযোগও করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে ব্যাংকটির ওপর আমানতকারীদের অনাস্থা বেড়ে যায়।
ব্যাংকটিকে ছাড় দেওয়ার কারণ ছিল, ২০২১ সালের ২ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিনিয়োগ ব্যাংক ডেল মরগান অ্যান্ড কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন। তখন বলা হয়েছিল, ডেল মরগান অ্যান্ড কোম্পানি পদ্মা ব্যাংকের জন্য ৭০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ আনতে মধ্যস্থতা করবে, যা বাংলাদেশের ৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকার মতো। সমঝোতা স্মারক সই অনুষ্ঠানে পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাত ও ডেল মরগানের চেয়ারম্যান রব ডেলগাডো উপস্থিত ছিলেন।
কিন্তু দীর্ঘদিনেও সেই বিনিয়োগ আসেনি। বরং দিনে দিনে ব্যাংকটির লোকসান বেড়েছে।
সমস্যা প্রকট হয়ে ওঠায় পদ্মা ব্যাংক শেষ পর্যন্ত বড় আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে না পেরে তাদের শেয়ার দেওয়ার পরিকল্পনা করে। এই ব্যাংকের আমানতকারীদের মধ্যে সবই সরকারি ব্যাংক, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সরকারি খাতের ট্রাস্ট তহবিল। তারা পদ্মা ব্যাংকের শেয়ার নেওয়ার ব্যাপারে সাড়া দেয়নি। ফলে ব্যাংকটির সামনে একীভূত হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ থাকেনি।
গত ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের শেষে পদ্মা ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত ২ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী ব্যাংক ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) ১ হাজার কোটি টাকা এবং জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড ও জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের ৭৬০ কোটি টাকা। এ ছাড়া বাকি এক হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি আমানত হচ্ছে জীবন বীমা করপোরেশন, সাধারণ বীমা করপোরেশন, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, তিতাস গ্যাস, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি), মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ অবকাঠামো ফিন্যান্স ফান্ড লিমিটেড (বিআইএফএফএল), ইসলামিক ফাউন্ডেশন, নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের। গত কয়েক বছরে ব্যাংকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ৮৭৪ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে। এখন এসব প্রতিষ্ঠান জমা টাকা ফেরত পাচ্ছে না, কেউ কেউ সুদও পাচ্ছে না।
ব্যাংকটির দেওয়া ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৩ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা। ফলে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণের হার প্রায় ৬২ শতাংশ। ফলে ঋণ থেকে যে আয় হচ্ছে, তা দিয়ে আমানতের সুদ পরিশোধ করা যাচ্ছে না। ব্যাংকটি এখন বড় লোকসানে চলছে। এমন পরিস্থিতিতে গত মাসের শুরুতে ব্যাংকের চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাত পদত্যাগ করেন। এর পর থেকে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম পদ্মা ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি সোনালী ব্যাংকের প্রতিনিধি হিসেবে ব্যাংকটির পরিচালক। গতকাল বৃহস্পতিবার পদ্মা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
জানতে চাইলে পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারেক রিয়াজ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের পর্ষদ এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা ও পরামর্শ মেনে ঠিক হবে, পরবর্তীতে কী হবে।’