মালিকদের ঠিকই খুশি রাখা হয়েছে। পরিচালকদের সংখ্যায় সামান্য পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এসব পরিবর্তন সামান্য ইতিবাচক।
যেসব পরিবর্তন
দুর্বল ব্যাংক দেউলিয়া ঘোষণার বিধান।
একই পরিবার থেকে পরিচালক হতে পারবেন তিনজন।
পর্ষদ সদস্য বা আত্মীয়দের জামানত দিয়ে ঋণ নিতে হবে।
পেশাজীবী, ব্যবসায়িক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক সংগঠনের পদ পাবেন না।
বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মেনে ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধনের খসড়া অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। এতে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা অনেকটাই অসুবিধায় পড়বেন। অবশ্য সরকারি নানা সুবিধা পেয়ে যাঁরা খেলাপির তালিকার বাইরে থাকেন, তাঁদের কোনো সমস্যা হবে না। তবে সরকার ব্যাংকমালিকদের ঠিকই খুশি রেখেছেন। পরিচালকদের সংখ্যায় সামান্য পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এসব পরিবর্তন সামান্য ইতিবাচক।
সংশোধিত খসড়া অনুযায়ী, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবার থেকে পরিচালক হতে পারেন এখন ৪ জন এবং টানা ৯ বছর তাঁরা থাকতে পারেন। অর্থাৎ টানা ৯ বছর পর্ষদে থাকার সুযোগ কমানোর বিষয়ে কোনো প্রস্তাব নেই সরকারের। তবে একই পরিবার থেকে পরিচালক হতে পারবেন চারজনের বদলে তিনজন।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গতকাল মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন, ২০২৩ এর এই খসড়া অনুমোদন করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) মো. মাহমুদুল হোসাইন খান সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
পর্ষদে একজন পরিচালক কমানোর পাশাপাশি বড় পরিবর্তন আনা হচ্ছে অবশ্য ঋণখেলাপিদের বিষয়ে। আইনের খসড়ায় প্রথমবারের মতো ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তাঁদের সুবিধা কমানোর প্রস্তাবও রয়েছে এতে। বলা হয়েছে, পরিচালনা পর্ষদের সদস্য বা আত্মীয় যে-ই হোক না কেন, তাঁদের সবাইকেই জামানত দিয়ে ঋণ নিতে হবে। আর ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিদেশ যাওয়া আটকে দিতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া প্রথমবারের মতো দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে প্রস্তাবিত আইনে।
সচিব মো. মাহমুদুল হোসাইন খান এ নিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, সামর্থ্য থাকার পরও ঋণ পরিশোধ না করলে; জালিয়াতি, প্রতারণা বা মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে ঋণ নিলে; যে উদ্দেশ্যে ঋণ নিয়েছিলেন, সেই উদ্দেশ্যে তা ব্যয় না করলে তাঁকে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি বলা হবে। তিনি আরও বলেন, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হওয়ার পর কেউ তা না দিলে প্রথমে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক একটি তালিকা দেবে বাংলাদেশ ব্যাংকে। কোনো ব্যাংক যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ইচ্ছাকৃত খেলাপির তালিকা না পাঠায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তখন ওই ব্যাংককে কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা এবং সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা জরিমানা করতে পারবে।
ঋণ পরিশোধে খেলাপি গ্রাহকেরা প্রথমে নোটিশ পাবেন বলে জানান সচিব মাহমুদুল হোসাইন খান। তিনি বলেন, নোটিশ পাওয়ার দুই মাসের মধ্যে তাঁকে টাকা পরিশোধ করতে হবে। না করলে অর্থঋণ আদালতের মাধ্যমে টাকা আদায়ের যে প্রচলিত ব্যবস্থা রয়েছে, তা চলমান থাকবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা, তাঁদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্সের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও কোম্পানি নিবন্ধনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ব্যবস্থা করতে পারবে।
৪৭০ কোটি ডলার ঋণ প্রস্তাব অনুমোদিত হওয়ার আগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দল বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করে এক পরিবার থেকে ৪ জন এবং টানা ৯ বছর ব্যাংকের পরিচালক থাকার সুযোগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। গত ৩২ বছরে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন হয়েছে ৭ বার। এর মধ্যে ব্যাংক মালিকদের চাপে এক পরিবার থেকে ৪ জন এবং টানা ৯ বছর ব্যাংকের পরিচালক থাকার সুযোগ দিয়ে সর্বশেষ আইন সংশোধন করা হয় ২০১৮ সালে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা আংশিক ইতিবাচক। ব্যাংক খাতে সংস্কার দরকার, আমরা বহু বছর ধরে বলে আসছি, ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের আগে আইএমএফও পরামর্শ দিয়ে গেছে। তবে আধা খেঁচড়া কাজ করে এ খাতের কোনো লাভ হবে না।’
সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ‘এক পরিবার থেকে ব্যাংকের পরিচালক হতে পারেন বড়জোর দুই জন এবং তাঁদের জন্য তিন বছরের একটি মেয়াদ দেওয়া যেতে পারে। আরেকটু উদারভাবে বললে তাঁরা ছয় বছর পর্যন্তও থাকুন। কিন্তু ৯ বছর কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এখন এক পরিবারের চারজনের জায়গায় তিনজন পরিচালক করা হচ্ছে যাতে আইএমএফকে অন্তত বলা যায় যে আমরা কিছু করলাম।’
দুর্বল-সবল একীভূত হওয়ার সুযোগ
ব্যাংক কোম্পানি আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যাংক মনে করেন যে তাঁর বিদ্যমান আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে বা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে, তাহলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তা বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাবে। আর্থিক অবস্থা খারাপ বলতে তারল্য, সম্পদের গুণগত মান ও মূলধন পরিস্থিতি খারাপ হওয়া এবং সুশাসন বজায় রেখে পরিচালনা সম্ভব না হওয়াকে বোঝানো হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক তখন ব্যাংকটিকে পুনরুদ্ধারের ব্যবস্থা করবে। তার আগে একটি পুনরুদ্ধার কর্মপরিকল্পনা বাংলাদেশ ব্যাংকে দাখিল করবে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। বাংলাদেশ ব্যাংক দুই বছর সময় দিয়ে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে কি না, তা দেখবে। পুনরুদ্ধার কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হলে অবসায়নই হবে ব্যাংকটির অনিবার্য পরিণতি।
সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর দেউলিয়া ঘোষণা করার বিধানও রাখা হচ্ছে আইনে। তবে বাঁচানোর চেষ্টার অংশ হিসেবে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ, অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা, প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া ইত্যাদি সুযোগ রাখবে।
আইনের খসড়া প্রণয়নে যুক্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। বিভাগটির সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তবে বিভাগটির একজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা বলেন, দুর্বল ব্যাংক সবলের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে ঠিক, তবে বাংলাদেশ ব্যাংককে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে—পচা কোনো ব্যাংক ভালো কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হয়ে যেন ওই ভালো ব্যাংকটিকেও পচা না বানিয়ে ফেলা।
আসছে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিপদ
আইনের খসড়া অনুযায়ী ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো সম্মাননা পাবেন না। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে দাওয়াতও পাবেন না তাঁরা। কোনো পেশাজীবী, ব্যবসায়িক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক সংগঠনের কোনো পদেও তাঁরা থাকতে পারবেন না।
বিদেশ ভ্রমণ ঠেকানোর পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণখেলাপিদের গাড়ি-বাড়ি নিবন্ধন ও ট্রেড লাইসেন্স এবং যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধকের পরিদপ্তরে (আরজেএসসি) নিবন্ধনে নিষেধাজ্ঞা আরোপের চিঠি পাঠাবে।
ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের ব্যাপারে প্রতিটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দুটি করে কমিটি থাকবে। একটি কমিটি তাঁদের চিহ্নিত করবে, আরেকটি কমিটি তা চূড়ান্ত করবে। পরে প্রতিটি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের তালিকা পাঠাবে বাংলাদেশ ব্যাংকে। তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার পর সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ৩০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে আপিল করতে পারবেন। তবে এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।
ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ওই তালিকা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পাঁচ বছর পার না হওয়া পর্যন্ত কোনো ব্যাংক কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে পারবেন না।
খসড়া আইনটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হওয়ার খবর জেনে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, এটা ভালো দিক। তাঁদের বিষয়ে আরও বেশি সুনির্দিষ্ট করতে পারলে ইচ্ছা করে খেলাপি হওয়ার প্রবণতা কমে আসবে।
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, সংশোধিত আইনে ভালো কিছু বার্তা পাওয়া যাচ্ছে। এক পরিবার থেকে তিনজন পরিচালক রাখার বিষয়টিও ইতিবাচক। এ তিনজনের মধ্যে অবশ্য পরিবারের পাশাপাশি মনোনীত পরিচালকদের যুক্ত করতে পারলে আরও ভালো হয়। সব মিলিয়ে দরকার হচ্ছে ব্যাংক খাতে সুশাসন জোরদার করা।