জনতা ব্যাংকের আলোচিত গ্রাহক অ্যাননটেক্স গ্রুপের এক বন্ধ প্রতিষ্ঠানের জন্য ৭০০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করেছে তারল্যসংকটে থাকা ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি। ঋণ পাওয়া প্রতিষ্ঠানটি হলো শব মেহের স্পিনিং মিলস লিমিটেড। ইতিমধ্যে এই ঋণ থেকে চলতি মাসের প্রথম ২ দিনে ১৪০ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটির কারখানা নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার সাধারচর ইউনিয়নের তাতারকান্দী গ্রামে। গত মঙ্গলবার কারখানায় গিয়ে জানা যায়, কারখানাটি এক বছর ধরে বন্ধ আছে।
ব্যাংকটির নির্বাহী কমিটির (ইসি) ১৯৯৭তম সভায় এই ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এই সভা হয়েছে গত ২৪ আগস্ট। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান আহসানুল আলম নিজেই ব্যাংকটির নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান। তিনি এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলমের ছেলে। ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয় এস আলম গ্রুপ। নানা অনিয়মের কারণে গত বছরের ডিসেম্বরে ব্যাংকটিতে যাকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, তিনিও ওই সভায় যোগ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকের একাধিক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
গত জুলাই থেকে ইসলামী ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপকদের (ব্রাঞ্চ ম্যানেজার) ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়। এমনকি বিভাগীয় ও জোনপ্রধানদেরও ঋণ অনুমোদনের ক্ষমতা বন্ধ করা হয়। তবে কৃষি খাতে তাঁদের ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা বহাল রাখা হয়েছে। ব্যাংকটির মোট ঋণের মাত্র ৩ শতাংশ কৃষিতে। এরপরই ব্যাংকটির পরিচালকেরা নতুন এই ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
জানতে চাইলে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকের ইসি সভায় প্রতিষ্ঠানটির ঋণ অনুমোদন হয়েছে। বন্ধ কোম্পানিতে ঋণ দেওয়ার কারণ ও ঋণের অর্থ ইতিমধ্যে তুলে নেওয়া বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো জবাব দিতে রাজি হননি।
এদিকে ইসলামী ব্যাংক এখনো আমানতের বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংকে চাহিদামতো নগদ জমা (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) রাখতে পারছে না। এ জন্য প্রতিদিন জরিমানা হলেও জরিমানার টাকা দিতে পারছে না ব্যাংকটি। এ অবস্থায় মাঝেমধ্যে টাকা ধার দিয়ে ইসলামী ব্যাংকের চেক ক্লিয়ারিং ও অনলাইন লেনদেনব্যবস্থা সচল রাখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে বন্ধ প্রতিষ্ঠানে নতুন করে ঋণ দেওয়া নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে।
ঋণ অনুমোদন যেভাবে
জানা যায়, শব মেহের স্পিনিং মিলস লিমিটেড মূলত জনতা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে গড়ে ওঠা একটি কারখানা। গত বছর পর্যন্ত ব্যাংকটিতে প্রতিষ্ঠানটির ঋণ ছিল প্রায় ১৮০ কোটি টাকা। জনতা ব্যাংকের বড় গ্রাহকদের একজন অ্যাননটেক্স গ্রুপ। গত বছরের নভেম্বরে অ্যাননটেক্সের ঋণের ৩ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা সুদ মওকুফ করার সিদ্ধান্ত নেয় জনতা ব্যাংক। জুন মাসের মধ্যে অ্যাননটেক্সকে ৪ হাজার ৮২০ কোটি টাকা শোধ করার শর্ত দেওয়া হয়। তবে গ্রুপটি এতে ব্যর্থ হয়। এরপর জনতা ব্যাংকের বোর্ডের পরিচালনা পর্ষদ গত ২৫ জুলাই ঋণটি শোধের জন্য চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দেয়। তবে এবার নতুন শর্ত হিসেবে অ্যাননটেক্সকে তাদের দুটি প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রাপ্য অর্থ জনতা ব্যাংকে জমা দিতে বলা হয়।
গত ২৪ আগস্ট ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় অ্যাননটেক্সের প্রতিষ্ঠান শব মেহের স্পিনিং মিলস লিমিটেডের ৭০০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করা হয়। এর মধ্যে ৫০০ কোটি টাকা নন–ফান্ডেড (ঋণপত্র, গ্যারান্টি) ও ২০০ কোটি টাকা ফান্ডেড (সরাসরি ঋণ)। এর আগে ১৬ জুলাই ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়সংলগ্ন ফরেন এক্সচেঞ্জ করপোরেট শাখায় শব মেহের স্পিনিং মিলসের নামে হিসাব খোলা হয়। এই হিসাবে জমা হওয়া ঋণের অর্থ থেকে ৫ সেপ্টেম্বর ৩ দফায় ৭০ কোটি টাকা ও ৭ সেপ্টেম্বর ৪ দফায় ৭০ কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়। ব্যাংকটি মুরাবাহা টিআর পদ্ধতিতে এই ঋণ বিতরণ করে। যার মাধ্যমে কোনো পণ্য কেনার জন্য ঋণ ছাড় করা হয়। তবে বাস্তবে কোনো পণ্য কেনার তথ্য পাওয়া যায়নি।
ইসলামী ব্যাংকের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তারা বলছেন, অ্যাননটেক্সের কিছু কোম্পানি কেনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে এস আলম গ্রুপ। এই কারণে ঋণটি তড়িঘড়ি করে ছাড় করা হয়েছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মে এক ব্যাংক থেকে অর্থ নিয়ে অন্য ব্যাংকের ঋণ শোধ দেওয়ার কোনো আইনি সুযোগ নেই।
জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল জব্বার গত বুধবার তাঁর কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘অ্যাননটেক্স গ্রুপের ঋণ পুনঃ তফসিল করা আছে। জুন পর্যন্ত এর মেয়াদ ছিল, যা ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। গ্রুপটি তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো বিক্রির চেষ্টা করছে বলে শুনেছি। আমরাও দুটি প্রতিষ্ঠান বিক্রি করার অনুমতি দিয়েছি। বিক্রি করতে হলে আমাদের সব ঋণ শোধ করে দিতে হবে। এখন পর্যন্ত কোনো টাকা পাইনি।’
তারল্যসংকট কাটেনি, কোনো শাস্তিও হয়নি
এদিকে ইসলামী ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে নানা ঋণ বের হওয়ার পর তারল্যসংকটে ভুগছে ব্যাংকটি। যদিও এভাবে ঋণ দেওয়ার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের কারও শাস্তি হয়নি, বরং কাউকে কাউকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। ইসলামী ব্যাংকের তারল্যসংকটের ফলে এস আলম গ্রুপভুক্ত আরও চারটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকও তারল্যসংকটে রয়েছে। কারণ, এসব ব্যাংক তারল্যসহায়তার জন্য ইসলামী ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল ছিল।
গত বৃহস্পতিবার মুডিস ইনভেস্টর সার্ভিসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোয় তারল্যসংকট দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। গ্রাহকদের আমানতের পরিমাণ কমে যাওয়া এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া অধিকাংশ সহায়তামূলক ব্যবস্থা ঠিকঠাক কাজে লাগাতে না পারার কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তারল্যঘাটতির প্রভাব ব্যাংকগুলোর ঋণমানেও পড়তে পারে। এতে দেশের ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলো স্বল্পমেয়াদি দায় মেটাতে সমস্যায় পড়তে পারে।
মুডিস বলছে, ২০২২ সালে দেশের ১০টি ইসলামি ধারার ব্যাংক আইন অনুসারে তারল্য বজায় রাখতে পেরেছিল; কিন্তু ৬ মাস পর দেখা যাচ্ছে, ১০টির মধ্যে ৪টি ব্যাংক এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে। ৬টি ব্যাংক বিধি অনুসারে তারল্য বজায় রাখতে পারলেও তাদের অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ছিল কম।
আরেকটি শীর্ষস্থানীয় ঋণমান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান ফিচ রেটিংস বলেছে, ঋণ অনিয়মের কারণে প্রচলিত ব্যাংকগুলোর তুলনায় বেশি তারল্যসংকটে ভুগছে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২৪ নভেম্বর ইসলামী ব্যাংকের আমানত ছিল ১ লাখ ৫১ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা, যা গত ডিসেম্বর কমে হয় ১ লাখ ৪১ হাজার ৬০ কোটি টাকা। এরপর গত আগস্ট শেষে আমানত বেড়ে ১ লাখ ৪৯ হাজার ১৭ কোটি টাকা হলেও আবার তা কমে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৭৯২ কোটিতে নেমেছে। এসব আমানত জমা রেখেছেন প্রায় দেড় কোটি গ্রাহক। ব্যাংকটির আমানতকারীদের বড় অংশ গ্রামীণ এলাকার। তবে ঋণ যাচ্ছে সব ঢাকা ও চট্টগ্রামে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক এই ব্যাংকের অনিয়ম নিয়ে নির্বিকার। আমানতকারীদের অর্থের নিরাপত্তা দিতে এই ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা এখনই কেড়ে নেওয়া উচিত। দীর্ঘদিন ধরে দেশের ব্যাংকটিকে শেষ করে ফেলা হচ্ছে, সরকারি কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
সরেজমিন যা দেখা গেল
মঙ্গলবার দুপুরে শিবপুর উপজেলার সাধারচর ইউনিয়নের তাতারকান্দী গ্রামের শব মেহের স্পিনিং মিলে গিয়ে প্রথম আলোর নরসিংদী প্রতিনিধি প্রণব কুমার দেবনাথ দেখেন যে কারখানাটির প্রধান ফটক বন্ধ, কোনো সাইনবোর্ডও নেই। বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর আবদুর রহিম (৬৫) ও ফজলুল হক কাজী (৬০) নামের দুজন নিরাপত্তাকর্মী এসে গেট খুললে ভেতরে প্রবেশ করেন এই প্রতিনিধি। প্রথমেই চোখ পড়ে কারখানার দেয়ালে সাঁটানো একটি সাইনবোর্ডের ওপর। সেখানে ইংরেজিতে লেখা ‘শব মেহের স্পিনিং মিলস লিমিটেড, ফাইন্যান্সড বাই জনতা ব্যাংক লিমিটেড’।
স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, তুলা থেকে সুতা তৈরির এই কারখানার প্রতিষ্ঠাতা অ্যাননটেক্সের মালিক ইউনুছ বাদল। দাদি শব মেহেরের নামে সাত-আট বছর আগে কারখানাটি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। প্রথম প্রায় তিন বছর নিজেই পরিচালনা করেন। পরে দুই বছর বন্ধ থাকার পর আরেকটি প্রতিষ্ঠানের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়। তারা প্রায় এক বছরের মতো চালানোর পর লোকসান হওয়ায় কারখানা ছেড়ে দেয়। এর পর থেকে এক বছর ধরে কারখানাটি পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। দিনরাতের জন্য মোট ১৪ জন নিরাপত্তাকর্মী ছাড়া এখানে আর কেউ নেই। এক বছর আগেও ৭০০-৮০০ শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করতেন।
কারখানাটি ঘুরে দেখা গেছে, বিশাল এলাকাজুড়ে নির্মিত কারখানাটির মাঝখানে বড় অংশজুড়ে টিনের একাধিক শেড। রয়েছে একটি ছয়তলা ভবনও। তবে সব কটিই তালাবদ্ধ। ভবন বাদে বাকি অংশ জঙ্গলে ভরে আছে। নানা জায়গায় ফুটে আছে কাশফুল। তালাবদ্ধ থাকায় ভবনগুলোর ভেতরে থাকা মেশিনপত্র দেখা সম্ভব হয়নি।