আজ ৫ জুলাই বেসরকারি খাতের ঢাকা ব্যাংক লিমিটেডের ২৮তম বর্ষপূর্তি। দ্বিতীয় প্রজন্মের ব্যাংকটির অর্জন, চ্যালেঞ্জ ও পরিকল্পনাসহ দেশের ব্যাংক খাতের নানা বিষয়ে কথা বলেছেন এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এমরানুল হক। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সানাউল্লাহ সাকিব।
প্রথম আলো: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ডলার–সংকট শুরু হয়, যা এক বছরের বেশি সময় ধরে চলছে। ডলার–সংকট কতটা সামাল দিতে পেরেছেন?
এমরানুল হক: ঢাকা ব্যাংকের দেওয়া ঋণের ৮৫ শতাংশ গেছে করপোরেট খাতে। এর বড় অংশই আবার বাণিজ্যনির্ভর। অর্থাৎ পোশাক ও টেক্সটাইল, রড–স্টিল এবং ভোগ্যপণ্য খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোই আমাদের বড় গ্রাহক। ডলারের সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক খুবই নিবিড়। সে জন্য ডলারের সংকট যখন শুরু হলো, তখন আমরা খুবই সমস্যায় পড়ে যাই। এরপর সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক নানা উদ্যোগ নেওয়ায় আমদানি কমে যায়। ফলে আমাদের ব্যবসার সঙ্গে আয়ও কমে যায়। বিদেশি দায় পরিশোধে আমাদের যে প্রতিশ্রুতি ছিল, সেটি মেটানোর মতো ডলার আমরা বাজারে পাইনি। ভালো পোশাক কারখানাগুলো আমাদের গ্রাহক হওয়ায় ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় ডলারের আয় ভালো হয়েছে। তাতে কোনোমতে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হয়। বিদেশি কোনো দায় পরিশোধে আমরা ব্যর্থ হয়নি, এটা একটা বড় অর্জন। তবে আমাদের সংকটের প্রায় ৮০ শতাংশ কেটে গেছে। আগে আমাদের ডলার আয়ের চেয়ে ডলার খরচ বেশি ছিল। এখন চাহিদা ও জোগান সমান হয়ে গেছে।
প্রথম আলো: ডলার–সংকটের সঙ্গে টাকার সংকটেও পড়েছে কিছু ব্যাংক। বিশেষ করে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো। আপনাদের কী অবস্থা?
এমরানুল হক: আমাদের ব্যাংক থেকে কোনো আমানত উঠে যায়নি। বরং যেসব ব্যাংকের আমানত কমেছে, সেখান থেকে আমরা কিছু আমানত পেয়েছি। বিশেষ করে ইসলামি ব্যাংকিং সেবায়। এখন আমাদের দুটি শাখা পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। তবে সব শাখাতেই ইসলামি ব্যাংকিং সেবা দেওয়া হচ্ছে। এই সেবায় ৭০-৮০ শতাংশ আমানত বেড়েছে। আমানত ৮০০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা হয়েছে।
প্রথম আলো: দেশের অর্থনীতিতে নানা সংকটের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ব্যাংকগুলোতে ফোর্সড ঋণ বাড়ছে। আপনাদের ব্যাংকের অবস্থা কী?
এমরানুল হক: আমরা খুব নিবিড়ভাবে এসব বিষয় পর্যবেক্ষণ করছি। অন্যান্য ব্যাংকের মতো আমাদের ব্যাংকেও ফোর্সড ঋণ হচ্ছে। এমনটা ঘটছে আমদানিকারকেরা বিল পরিশোধ করতে না পারায়। অনেক পণ্য রপ্তানিতে দেরি হচ্ছে। আবার সরকারি অনেক বিল সময়মতো ছাড় হচ্ছে না। যেমন সার আমদানি হয়ে গেলেও সরকার কিন্তু ভর্তুকির টাকা ছাড় করেনি। ব্যাংকে মেয়াদোত্তীর্ণ বিল এবং রপ্তানি আয় সময়মতো না আসার ঘটনাও বাড়ছে। এটা সব ব্যাংককে ভাবাচ্ছে। এসব সমন্বয় হয়ে গেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
প্রথম আলো: এই সময়ে ঋণের চাহিদা কেমন, বিশেষ করে প্রকল্প ঋণ ও এসএমই ঋণে?
এমরানুল হক: বেসরকারি খাতে ঋণ কমছে। দুই ঈদে ঋণের তেমন চাহিদা দেখা যায়নি। নগদ টাকা উত্তোলনও তেমন হয়নি। বৈশ্বিক ও স্থানীয় পরিস্থিতি বিবেচনায় কেউ ব্যবসা সম্প্রসারণ বা নতুন প্রকল্প করছে না। আমরা মনে করেছিলাম যে অনেকগুলো অর্থনৈতিক অঞ্চল যখন হলো, তখন ঋণের চাহিদা বাড়বে। কিন্তু সেটা হয়নি। পরিস্থিতি কোন দিকে যায়, সেটা দেখার জন্য সবাই অপেক্ষা করছেন।
এসএমই ঋণেও তেমন চাহিদা নেই। কারণ, এই খাতটি বড় করপোরেটদের ওপর নির্ভরশীল। ছোটরা বড় করপোররেটদের কাঁচামাল ও পণ্য সরবরাহ করে থাকে, আবার পরিবেশক হিসেবেও কাজ করে। বড় করপোরেটদের ব্যবসার গতি কমে আসায় ছোটদেরও ঋণের চাহিদা কমে গেছে।
প্রথম আলো: সুদহারের নতুন যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। সুদ কম থাকার প্রভাব কেমন পড়ল অর্থনীতিতে?
এমরানুল হক: এখন তারল্যের ওপর একটা চাপ আছে। এ জন্য ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার বাড়াচ্ছে। সুদহারের নতুন পদ্ধতি চালু হওয়ায় ব্যাংকগুলো আমানতে বেশি সুদ দিতে পারবে। এতে আমানতকারীরা আগের চেয়ে বেশি সুদ পাবেন। ঋণের চাহিদা বাড়লে তারল্যের ওপর আরও চাপ তৈরি হবে। তখন সুদের হার বাড়লেও ব্যাংকের আয়ে এর প্রভাব পড়বে কম। কারণ, আমানতের খরচ বেড়ে যাবে। সামনে আমানতকারীরা ভালো সুদ পাবেন।
২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ৯ শতাংশ সুদহার নির্ধারণ করে দিতে না দিতেই করোনাকাল শুরু হয়ে গেল। এরপর আবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব শুরু হলো। ফলে কম সুদের কারণে ঋণের চাপ তৈরি হয়নি। সুদের হার কমার প্রভাব আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। কারণ, এই সময়ে উদ্যোক্তারা সরকারি ভর্তুকির সুবাদে আরও কম সুদে ঋণ পেয়েছেন।
প্রথম আলো: গত ২৮ বছরে ঢাকা ব্যাংকের মূল অর্জনগুলো কী?
এমরানুল হক: গ্রাহকের আস্থা আমাদের বড় অর্জন। গ্রাহকের আস্থা অর্জনের পেছনে রয়েছে পর্ষদের পেশাদার মনোভাব, সুশাসন, দক্ষ মানবসম্পদ ও প্রযুক্তির উৎকর্ষ। এর সঙ্গে রয়েছে সম্পদের মান ভালো রাখার প্রভাব। ঢাকা ব্যাংক ধীরে ধীরে বড় হয়েছে। এই যাত্রাপথে সম্পদের মান খারাপ হতে দেয়নি। সুশাসনের ক্ষেত্রে আমরা কোনো আপস করিনি। ফলে গ্রাহকের আস্থা বরাবরের মতো আমাদের সঙ্গে আছে। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন। আমাদের ব্যাংকে এখন ৬ লাখ আমানত হিসাব রয়েছে। ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ ২৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, ঋণ রয়েছে ২৪ হাজার কোটি টাকার। আমাদের স্থায়ী কর্মী প্রায় দুই হাজার। সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কর্মী কাজ করছেন ঢাকা ব্যাংকে।
প্রথম আলো: কোন খাতের ঋণে ঢাকা ব্যাংকের নজর বেশি? নতুন পরিকল্পনা কী?
এমরানুল হক: ঢাকা ব্যাংক শুরু থেকেই করপোরেট ঋণে বেশি নজর দিয়েছে। আমাদের গ্রাহকেরা বিদেশি ব্যাংকেরও গ্রাহক। তাই বলা যায়, দেশের ভালো গ্রাহকেরা আমাদের গ্রাহক। অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে এসএমই খাতে আমরা নজর বাড়িয়েছি। দেশে মধ্যম আয়ের মানুষ বৃদ্ধি পাওয়ায় ভোক্তাঋণও বাড়ছে। এখন আমাদের ৮৫ শতাংশ ঋণ রয়েছে করপোরেট খাতে, বাকি ১৫ শতাংশ এসএমই ও ভোক্তাঋণ। আমরা ২০২৬ সালের মধ্যে করপোরেট ঋণ ৬৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে এবং এসএমই ও ভোক্তাঋণ বাড়িয়ে ৩৫ শতাংশে তুলতে চাই।
প্রথম আলো: এসএমই ও ভোক্তাঋণের সুদহার বাড়লে এমন লক্ষ্য অর্জিত হবে কীভাবে?
এমরানুল হক: সুদহার যেটা বাড়ছে, সেটা খুব বেশি না। বাজারের চেয়ে একটু বেশি। আগে একসময় সুদহার ১৭-১৮ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছিল। সেটা অর্থনীতির জন্য ভালো ছিল না। খরচ বেড়ে গেলে ব্যবসা করা কঠিন। তখন, বিশেষ করে নতুন উদ্যোক্তাদের পক্ষে ব্যবসা দাঁড় করানো কঠিন হয়ে যায়। এখন সুদের হার বাড়ানো হলেও এর প্রভাব ঋণে পড়বে না। এসএমই খাত দেশের অর্থনীতির প্রাণ। ভোক্তাঋণ মধ্যম আয়ের মানুষের বড় ভরসার জায়গা। এ জন্য এসব ঋণের চাহিদাও আছে। ফলে লক্ষ্য অর্জন করতে সমস্যা হওয়ার কথা না।
প্রথম আলো: ব্যাংকের পরিচালক ও ঋণখেলাপিদের সুযোগ দিয়ে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হলো। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
এমরানুল হক: ব্যাংক খাতের জন্য সুশাসন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আইনকানুন ও নীতিমালা এমনভাবে করা উচিত, যাতে ব্যাংক খাতের ওপর বিরূপ প্রভাব না পড়ে। ব্যাংক খাতকে আন্তর্জাতিক মানে নিতে হলে আইন আর নীতিমালাও সেই মানে উন্নীত করতে হবে। কারণ, দেশের অর্থনীতির গতি ধরে রাখতে শক্তিশালী ব্যাংক খাতের বিকল্প নেই।