বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের করা এক গবেষণায় অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধি অর্থনীতিতে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। এমন বৈশ্বিক প্রভাবে ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনা অসামঞ্জস্য হয়ে পড়বে। কারণ, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়লে ব্যাংকের ঋণ ওই খাতে বেড়ে যায়। আবার ডলারের দাম বাড়লেও ঋণের চাহিদা বাড়ে। এর ফলে বেসরকারি খাতের পাশাপাশি সরকারি খাতের ঋণ প্রাপ্তি কমে যেতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ মো. হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি দলের গবেষণা প্রতিবেদনে এমন মতামত তুলে ধরা হয়েছে। তবে এই মতামত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নয়, গবেষকদের ব্যক্তিগত মতামত। তাই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে ডলারের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে গবেষণায়।
কারণ, এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় কোনো নীতি সহায়তা নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে করা এ গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালক সেলিম আল মামুন ও উপপরিচালক নাসরিন আক্তার। গবেষণার বিষয় ছিল বেসরকারি খাতের ঋণে মুদ্রা বিনিময় হার ও বৈশ্বিক ভোগ্যপণ্যের দামের মূল্যস্ফীতি।
‘পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের সরবরাহ বাড়াতে উদ্যোগ নিয়েছে। আবার চাহিদা কমাতেও কাজ করছে। পাশাপাশি ডলারের দামকে বাজারমুখী করা হয়েছে।’মো. হাবিবুর রহমান, গবেষণা দলের প্রধান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে আমদানি-রপ্তানিতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৮ শতাংশ। গত মার্চে আমদানি-রপ্তানিতে তা বেড়ে ১৭ দশমিক ৯ শতাংশে উঠে। এরপর জুনে ও সেপ্টেম্বরে এ খাতে অর্থায়নে প্রবৃদ্ধি হয় যথাক্রমে ১৯ দশমিক ৩ ও ১৮ দশমিক ৮ শতাংশ। এর বড় কারণ ওই সময় বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বেড়ে গিয়েছিল। আবার দেশে ডলারের দামও বেড়ে যায় ওই সময়। তাতে প্রতি ডলারে খরচ বেড়ে যায় ১৫-২০ টাকা। এদিকে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি গত মার্চে ৬৯ দশমিক ৫ শতাংশে উঠে যায়। ফলে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি গত মার্চ, জুন ও সেপ্টেম্বরে বেড়ে হয় যথাক্রমে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ, ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ ও ১৩ দশমিক ৯ শতাংশ।
আমদানি-রপ্তানিতে বড় অর্থায়ন করা হয় ডলার, ইউরো, পাউন্ডসহ বিভিন্ন বিদেশি মুদ্রায়। তবে তা ব্যাংকের হিসাবে দেশীয় মুদ্রায় যায়।
এদিকে গত বছরের ডিসেম্বরে ব্যাংকের মোট অর্থায়নের ১৫ শতাংশই ছিল আমদানি-রপ্তানি খাতে। বাকি ৮৫ শতাংশ ছিল অন্য খাতে। তবে মার্চ থেকে গত অক্টোবর পর্যন্ত আমদানি-রপ্তানি খাতে অর্থায়ন ১৬ শতাংশে পৌঁছে যায়। ফলে অন্য খাতে ঋণ কমে ৮৫ শতাংশের নিচে নেমে আসে।
গবেষণায় উঠে আসে, করোনার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে তেল ও ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়। ফলে আমদানিতে বড় চাপ তৈরি হয়। এতে দেশের রিজার্ভে ওপর চাপ তৈরি হয়। ডলারের বিপরীতে টাকাও মান হারায়। এ কারণেই বেসরকারি খাতের ঋণ বেড়ে যায়।
গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর এপ্রিল থেকে দেশে ডলার-সংকট দেখা দেয়। এ সময়ের মধ্যে বিশ্ববাজারে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি খরচও বেড়ে যায়। তবে সেই তুলনায় বাড়েনি প্রবাসী ও রপ্তানি আয়। ডলারের দাম ধরে রাখে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এতে সংকট আরও প্রকট হয়। এরপর গত সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। পাশাপাশি আমদানি চাপ কমাতে ৩০ লাখ ডলারের বেশি ঋণপত্র যাচাই–বাছাই করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গত এপ্রিলে দেশে ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ১০৫ টাকা। আর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন থেকে কমে হয়েছে ৩৪ বিলিয়ন ডলার।
জানতে চাইলে গবেষণা দলের প্রধান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ মো. হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের সরবরাহ বাড়াতে উদ্যোগ নিয়েছে। আবার চাহিদা কমাতেও কাজ করছে। পাশাপাশি ডলারের দামকে বাজারমুখী করা হয়েছে।’
প্রবাসী আয় বাড়াতে চলতি বছরের শুরুতে প্রণোদনা ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে আড়াই শতাংশ করা হয়। আবার বাংলাদেশ ব্যাংক এখন বিকাশ, রকেট ও উপায়ের মতো মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস বা এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরাসরি প্রবাসী আয় আনার সুযোগ দিয়েছে।
নতুন সুবিধার ফলে বিদেশে বসে এসব সেবার মাধ্যমে বিদেশি মুদ্রায় লেনদেনের হিসাব খোলা যাবে। প্রবাসীরা দেশে এলে সেই হিসাবে টাকা ছাড়া অন্য মুদ্রায় লেনদেন করা যাবে না। এর ফলে বৈধ পথে আয় আসা বাড়বে বলে আশা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।