বৈশ্বিক সংকটে রপ্তানি খাতকে চাঙা রাখতে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ১০ হাজার কোটি টাকার রপ্তানি সহায়ক তহবিল গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। মূলত রিজার্ভের ডলার দিয়ে গঠিত রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) ওপর চাপ কমাতে গঠন করা হয় কম সুদের এই রপ্তানি সহায়ক তহবিল। তবে গত তিন মাসে রপ্তানি সহায়ক তহবিলের ঋণের সুবিধা মূলত নিয়েছেন তারল্য-সংকটে পড়া ছয় ব্যাংকের গ্রাহকেরা। সব মিলিয়ে এসব ব্যাংক পেয়েছে ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।
এর মধ্যে পাঁচটিই ইসলামি ধারার ব্যাংক ও একটি রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংক। ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলো হলো ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক। এর মধ্যে ইসলামি ধারার পাঁচ ব্যাংকই তারল্য-সংকটে পড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সম্প্রতি বিশেষ ব্যবস্থায় টাকা ধার নেয়। আর জনতা ব্যাংক প্রায় প্রতিদিনই কয়েক হাজার কোটি টাকা করে ধার করছে।
রপ্তানি সহায়ক তহবিল পরিচালনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই তহবিল থেকে ৪ শতাংশ সুদে টাকা নিয়ে রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল সংগ্রহ করতে পারছেন রপ্তানিকারকেরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক প্রথম আলোকে বলেছেন যে তহবিলটি সব ব্যাংকের জন্য উন্মুক্ত এবং যেসব ব্যাংক শর্ত পূরণ করে আবেদন জানাবে, তাদের সবাই এই তহবিল থেকে টাকা পাবে।
আমদানি ও স্থানীয় খাত থেকে কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য এই তহবিলের অর্থ ব্যবহার হওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে এর যথাযথ ব্যবহার নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কেউ কেউ ঋণ দিয়ে আগের ঋণ সমন্বয় ও পরিশোধ করছে বলে জানা গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোর তারল্য জোগানে এই তহবিল থেকে অর্থ নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে মেজবাউল হক বলেন, যেসব ব্যাংকের সমস্যা ছিল, তারা দ্রুত নথিপত্র জমা দিয়ে এই তহবিল থেকে অর্থ নিয়েছে।
দুটি ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, রপ্তানিকারকেরা আগে কাঁচামাল আমদানি করার পর ব্যাংকে টাকা জমা দিতেন। এখন তাঁরা এই তহবিল থেকে আগেই টাকা নিয়ে সেই অর্থ ব্যাংকে জমা করে রাখছেন। পরে কাঁচামাল আমদানি করা হলে সেখান থেকে খরচ করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকের তারল্য-সংকট মেটানোর একটা চেষ্টা হচ্ছে। সংকট নিরসনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকই এই উদ্যোগ নিয়েছে।
রপ্তানি খাতকে চাঙা রাখতে ১০ হাজার কোটি টাকার রপ্তানি সহায়ক তহবিল গঠন করা হয় ঋণ নিয়ে রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল সংগ্রহ করার জন্য। এতে সুদহার সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ। এ তহবিল থেকে ঋণ দেওয়া হয় দেশীয় মুদ্রায়।
রপ্তানি খাতকে সহায়তা দিতে আগে থেকেই রিজার্ভের অর্থে গঠন করা হয়েছিল রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ)। তহবিলটির আকার ৭০০ কোটি ডলার। সেখান থেকে কাঁচামাল আমদানি করতে বিদেশি মুদ্রায় ঋণ নিতে পারেন রপ্তানিকারকেরা। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের চাপে এই তহবিল ছোট করে আনছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঋণেও কড়াকড়ি আরোপ করেছে।
নতুন রপ্তানি সহায়ক তহবিল থেকে কারা ঋণ নিতে পারবে, সে ব্যাপারে নির্দেশনা রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। এতে বলা হয়েছে, স্থানীয় রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানি বা স্থানীয় পর্যায় থেকে সংগ্রহের বিপরীতে তহবিল থেকে অর্থায়ন নিতে পারবে। সরাসরি ও প্রচ্ছন্ন রপ্তানিকারক—উভয় ধরনের প্রতিষ্ঠানের জন্য এ তহবিল উন্মুক্ত থাকবে। তহবিলের অর্থ রপ্তানিকারকের ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্রের মাধ্যমে উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানির জন্য ব্যবহার করা যাবে। ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্রের বিপরীতে স্থানীয় উৎপাদনকারী ও সরবরাহকারী কাঁচামাল আমদানির এ তহবিল থেকে ঋণ নিতে পারবেন।
এই তহবিল থেকে ঋণ নেওয়ার পর পণ্য রপ্তানির বিপরীতে রপ্তানিমূল্য অপ্রত্যাবসিত থাকলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান নতুন করে আরও ঋণ পাবে না। নতুন ঋণ দেওয়ার আগে আগের ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্রের বিপরীতে সৃষ্ট দায়ের ন্যূনতম ৫০ শতাংশ নগদে পরিশোধ করতে হবে গ্রাহককে। সংশ্লিষ্ট গ্রাহক রপ্তানি ঋণপত্রের বিপরীতে কাঁচামাল আমদানির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্য কোনো তহবিল থেকে ঋণ নিয়ে থাকলে এ তহবিলের আওতায় কোনো ধরনের ঋণ পাবেন না।
রপ্তানি সহায়ক তহবিল থেকে একজন গ্রাহক সর্বোচ্চ ২০০ কোটি টাকা ঋণ নিতে পারেন।
রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংকের ৫ জন গ্রাহক এই তহবিল থেকে পেয়েছেন ৭২ কোটি টাকা। এই ঋণের ব্যবহার নিয়ে জানতে চাইলে জনতা ব্যাংকের এমডি আবদুছ ছালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, রপ্তানিকারকদের জন্য এই তহবিল থেকে টাকা নেওয়া হয়েছে। আগের ঋণ শোধ করা হয়েছে। গ্রাহকের হিসাবে টাকা থাকছে, যেখান থেকে ভবিষ্যতে খরচ করা হবে।
এই তহবিল থেকে সর্বোচ্চ অর্থ পেয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। ব্যাংকটির ৯৩ জন গ্রাহক পেয়েছেন ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। ব্যাংকটির ট্রেজারি ও বিনিয়োগ বিভাগের একটি সূত্র জানায়, এর মধ্যে মাহমুদ ডেনিম পেয়েছে ১১০ কোটি টাকা, জিএমএস ১৫৪ কোটি টাকা, এএ ইয়ার্ন পেয়েছে ১৪১ কোটি টাকা ও ইউনিটেক্স গ্রুপ পেয়েছে ৫২ কোটি টাকা। এ নিয়ে জানতে ইসলামী ব্যাংকের এমডি মুহাম্মদ মুনিরুল মওলাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।
এরপরই ৫৪৫ কোটি টাকা পেয়েছে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক। ৫৮ জন গ্রাহকের জন্য ব্যাংকটি এই টাকা পেয়েছে। ব্যাংকটি জানিয়েছে, এর মধ্যে সাদমান টেক্সটাইল পেয়েছে ৪৩ কোটি টাকা ও রিও ৩৪ কোটি টাকা।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জাফর আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই তহবিল থেকে আমরা প্রায় ৫০০ কোটি টাকা পেয়েছি। এ ছাড়া গত মাসে ব্যক্তি পর্যায়ে দেড় হাজার কোটি টাকা আমানত জমা হয়েছে, যা আমাদের তারল্য ব্যবস্থাপনায় কিছুটা হলেও স্বস্তি দিয়েছে। তহবিলের টাকা থেকে ধীরে ধীরে গ্রাহকের কাঁচামাল আমদানি করা হচ্ছে।’
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৩৭ জন গ্রাহক পেয়েছেন ৪৩২ কোটি টাকা। এর মধ্যে স্টারলেট অ্যাপারেলস পেয়েছে ৯২ কোটি টাকা ও শোরেইন এসটিএম ৫৭ কোটি টাকা। এ নিয়ে জানতে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের এমডি সৈয়দ ওয়াসেক মো. আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাড়া দেননি।
ইউনিয়ন ব্যাংকের ৬ জন গ্রাহক পেয়েছেন ৪৬ কোটি টাকা ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ২ জন গ্রাহক পেয়েছেন ৬ কোটি টাকা।
ইউনিয়ন ব্যাংকের এমডি এ বি এম মোকাম্মেল হক চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। আর গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের এমডি সৈয়দ হাবিব হাসনাত প্রথম আলোকে বলেন, ছুটিতে থাকায় এই তহবিল থেকে ঋণ নেওয়া সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না।
ইসলামি ধারার পাঁচ ব্যাংকই তারল্য-সংকটে পড়ে এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় টাকা ধার নিয়েছিল। আর রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের জনতা ব্যাংক তারল্য-সংকটের মধ্যে পড়ে এখন প্রায় প্রতিদিন সাত হাজার কোটি টাকার মতো ধার করেছে।
এই তহবিল গঠন করা হয়েছিল রপ্তানিকারকদের তাগিদে। তবে এ নিয়ে রপ্তানিকারকদের মধ্যে সচেতনতা কম। যদিও ইতিমধ্যে ২৭ শতাংশ ঋণ বিতরণ হয়ে গেছে। জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, এই তহবিল সম্পর্কে অনেক রপ্তানিকারক পুরোপুরিভাবে অবহিত নন। অথচ ইডিএফের মতো এই তহবিল ব্যবহার হওয়ার কথা ছিল।
তারল্য-সংকটে পড়া কিছু ব্যাংকের গ্রাহক ইতিমধ্যে এই তহবিলের অর্থ পেয়েছেন, এমনটা জানানো হলে মোহাম্মদ হাতেম বলেন, এই তহবিলের অপব্যবহার হতে দেওয়া উচিত হবে না। তিনি আরও বলেন, রপ্তানিকারকদের কাঁচামাল আমদানির জন্য এই তহবিল ব্যবহার হওয়ার কথা। কারও ঋণ পরিশোধের জন্য ব্যবহার হতে পারে না। এমনটা হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তৎপর হয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে।
রপ্তানি সহায়ক তহবিলের ঋণ দিয়ে আগের ঋণ সমন্বয় ও পরিশোধ করা হয়েছে কিংবা সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোর তারল্য জোগানে এই তহবিল থেকে অর্থ নেওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে, এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক প্রথম আলোকে বলেন, রপ্তানি সহায়ক তহবিলের অর্থ দেশের সব ব্যাংকের জন্যই উন্মুক্ত রাখা হয়েছে এবং যেকোনো ব্যাংক এখান থেকে অর্থ পেতে পারে।
মেজবাউল হক বলেন, যেসব ব্যাংকের সমস্যা ছিল, তারা দ্রুত নথিপত্র জমা দিয়ে এই তহবিল থেকে অর্থ নিয়েছে। কারণ, তাদের চাহিদা বেশি ছিল। অন্য যেসব ব্যাংক শর্ত পূরণ করে আসবে, সবাই এই তহবিল থেকে টাকা পাবে। এই তহবিল যে উদ্দেশ্যে গঠন করা হয়েছিল, তা এখনো সেভাবেই আছে।