বসুন্ধরায় ১৩৮ কাঠা জমি আবদুল হাই বাচ্চুর, বিক্রির চেষ্টা করছেন

বসুন্ধরা আবাসিকের দুটি প্লটের মালিক শেখ আবদুল হাই। স্থানীয়দের মতে, এ সম্পত্তির দাম ২৭৬ কোটি টাকা।

শেখ আবদুল হাই
শেখ আবদুল হাই

ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ১৩৮ কাঠা জমির মালিক বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনায় জড়িত প্রধান ব্যক্তি ও ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই ওরফে বাচ্চু। এই জমি বিক্রির জন্য জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি। দ্রুততম সময়ে যাতে এ জমি বিক্রি করা যায়, সে জন্য একাধিক লোকও নিযুক্ত করেছেন।

বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনায় গত জুনের মাঝামাঝি সময়ে শেখ আবদুল হাইয়ের বিরুদ্ধে ৫৮টি মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

দুদক, বেসিক ব্যাংক সূত্র ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, অভিযোগপত্র দাখিলের পরপরই দুই প্লটের ওই জমি বিক্রির তোড়জোড় শুরু হয়। যদিও চার মাস ধরে চেষ্টা করেও যথাযথ ক্রেতার সন্ধান পাননি শেখ আবদুল হাই। একবারে কেউ টাকা শোধ করলে বাজারদরের চেয়ে সস্তায় ওই জমি বিক্রি করতে তিনি রাজি বলেও জানা গেছে। তাঁর পক্ষে এ জমি বেচার দায়িত্ব পালন করছেন বাবুল মিয়া নামের এক ব্যক্তি। বসুন্ধরার স্থানীয় মানুষের কাছে তিনি আবদুল হাইয়ের সম্পত্তি দেখাশোনা করার ম্যানেজার হিসেবে পরিচিত।

শেখ আবদুল হাই দেশেই আছেন। আর ১৩৮ কাঠা সম্পত্তির বিষয়ে তাঁর কিছু জানা নেই। তবে আদালতের নিষেধাজ্ঞা না থাকলে কোনো সম্পত্তি তিনি বিক্রি করতে চাইতেই পারেন।
শেখ আবদুল হাইয়ের আইনজীবী সৈয়দ মাহসিব হোসেন

বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকার সময় ২০১২ সালে শেখ আবদুল হাই এই দুই প্লটের মালিক হন। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার আই ব্লকের ৭১৯ ও ৭২০ নম্বরধারী প্লটের আয়তন ২২৮ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। ৩৩ শতাংশে ১ বিঘা হিসাবে প্লট দুটির আয়তন ৬ দশমিক ৯ বিঘা, অর্থাৎ প্রায় ৭ বিঘা। ২০ কাঠায় ১ বিঘা হিসাবে পুরো সম্পত্তির পরিমাণ ১৩৮ কাঠা।

অভিযোগপত্র দাখিলের কয়েক মাস হলেও শেখ আবদুল হাইয়ের নামে এখনো কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়নি। দুদক বলছে, বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আদালতে আত্মসমর্পণ ছাড়া আইনজীবীর মাধ্যমে তিনি হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন পাওয়ার চেষ্টা করছেন।

জমি বিক্রির বিষয়ে শেখ আবদুল হাইয়ের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে তাঁর আইনজীবী সৈয়দ মাহসিব হোসেনের সঙ্গে গতকাল শনিবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, শেখ আবদুল হাই দেশেই আছেন। আর ১৩৮ কাঠা সম্পত্তির বিষয়ে তাঁর কিছু জানা নেই। তবে আদালতের নিষেধাজ্ঞা না থাকলে কোনো সম্পত্তি তিনি বিক্রি করতে চাইতেই পারেন।

স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, আশপাশের জমি প্রতি কাঠা ২ কোটি টাকা দরে কেনাবেচা হচ্ছে। সে হিসাবে শেখ আবদুল হাইয়ের এ জমির দাম প্রায় ২৭৬ কোটি টাকা।

বাচ্চুর বসুন্ধরার জমি

কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, মোট পরিমাণের মধ্যে সিএস ও এসএ ৩৩৬৯ নম্বর দাগে ২৩ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ, ৩৩৭০ নম্বর দাগে ৭৬ দশমিক ১৯ শতাংশ, ৩৩৭১ নম্বর দাগে ৪২ দশমিক ৫২ শতাংশ এবং ৩৩৭২ নম্বর দাগে ৮৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ জমি রয়েছে।

বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ১৯ অক্টোবর গিয়ে দেখা যায়, পুরো জমি লাল ইটের দেয়াল দিয়ে ঘেরা। দুটি প্লটের মাঝখানেও একটি দেয়াল রয়েছে। প্লট দুটির লাগোয়া চারদিকে রয়েছে ৮০ ফুট রাস্তা। উত্তরে অনেক আবাসিক ভবন রয়েছে। দক্ষিণে নির্মাণাধীন একটি বেসরকারি হাসপাতাল ও একটি আবাসন কোম্পানির সাইনবোর্ড-সংবলিত ভবন। পশ্চিমে বিদ্যুতের একটি উপকেন্দ্র এবং পূর্বে রাস্তাসংলগ্ন একটি বাড়ি।

শেখ আবদুল হাই ওরফে বাচ্চুর ১৩৮ কাঠা জমি বিক্রির কাজে নিয়োজিত বাবুল মিয়ার সঙ্গে ৫ নভেম্বর মুঠোফোনে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। জমি বিক্রির হালনাগাদ তথ্য জানতে চাইলে বাবুল মিয়া বলেন, তিনি শেখ আবদুল হাইয়ের গাড়িচালক ছিলেন। এক মাস ধরে তিনি অসুস্থ থাকায় এ বিষয়ে কিছু জানেন না।

শেখ আবদুল হাই ২০০৯ সালে যোগ দেওয়ার সময় বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল মোট ঋণের ৫ শতাংশ আর ২০১৪ সাল শেষে তা দাঁড়ায় ৬৮ শতাংশে।

কোনো ক্রেতার সন্ধান পেয়েছেন কি না, জানতে চাইলে বাবুল মিয়া বলেন, ‘জমি বিক্রি নিয়ে কিছু বলতে পারব না।’ অবশ্য সরেজমিনে জানা গেল, বাবুল মিয়া প্রতি সপ্তাহে একবার এসে জমিতে চাষ হওয়া সবজির ভাগ নিয়ে যান। ভেতরের জমির কিছু অংশে চাষ হচ্ছে। আছে লাউ, বেগুন ও হলুদের গাছ। দেয়ালের ভেতরের অনাবাদি কিছু অংশে আছে কাশবন।

স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, আশপাশের জমি প্রতি কাঠা ২ কোটি টাকা দরে কেনাবেচা হচ্ছে। সে হিসাবে শেখ আবদুল হাইয়ের এ জমির দাম প্রায় ২৭৬ কোটি টাকা।

জমিতে ঢোকার জন্য দুই পাশে দুটি গেট রয়েছে। পূর্ব দিকের গেট খোলা থাকায় ভেতরে গিয়ে দেখা যায় কিছু অংশে নতুন করে মাটি ও ইটের টুকরা ফেলা হয়েছে। সাধারণত জমি ভরাট করার কাজে এভাবে মাটি ফেলা হয়।

শেখ আবদুল হাইয়ের পক্ষে জমি বিক্রির কাজে সাহায্যকারী হিসেবে এনামুল হায়দার নামের আরেকজনের সন্ধান পেয়েছেন এই প্রতিবেদক। ৭ নভেম্বর ঢাকার বনানীর একটি হোটেলে এনামুল হায়দার এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘অনেকের সঙ্গে কথা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত কারও সঙ্গে ফয়সালা হয়নি। একবারে কেউ কিনতে চাইলে দাম একটু কমানোর সুযোগ রয়েছে।’ কতটা কমতে পারে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা হতে পারে দেড় কোটি টাকার বেশি, কিন্তু দুই কোটির কম।

শেখ আবদুল হাই ১৯৮৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাগেরহাট-১ আসন থেকে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাঁকে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয় সরকার। বর্তমান সরকারের ওপর মহলের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকার বিষয়টি রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ আলোচিত।

শেখ আবদুল হাই ২০০৯ সালে যোগ দেওয়ার সময় বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল মোট ঋণের ৫ শতাংশ আর ২০১৪ সাল শেষে তা দাঁড়ায় ৬৮ শতাংশে। কেলেঙ্কারির পর এখন পর্যন্ত বেসিক ব্যাংককে বাজেট থেকে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা দিয়েছে সরকার। কিন্তু ব্যাংকটি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।

২ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা আত্মসাতের পেছনে

২০০৯-২০১৪ সময়ে দুই দফায় শেখ আবদুল হাই বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। এ সময়ে ব্যাংকটি থেকে ২ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচার হয় বলে দুদকের অনুসন্ধানে উঠে আসে। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকার মতিঝিল, পল্টন ও গুলশান থানায় ৫৯টি মামলা হয়। এর মধ্যে ৫৮টিতে তিনি আসামি। যদিও মামলা হওয়ার আট বছর পর ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছে দুদক।

বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকার সময় কেনা বসুন্ধরার ওই জমির বিষয়ে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান প্রথম আলোকে বলেন, আদালতের রায়ে যদি প্রমাণিত হয় শেখ আবদুল হাইয়ের সম্পত্তি ঘুষের টাকায় কেনা হয়েছে অথবা তিনি যদি সম্পত্তি কেনার অর্থের উৎস দেখাতে না পারেন, তাহলে এগুলো জব্দ করা হবে।

শেখ আবদুল হাই ২০০৯ সালে যোগ দেওয়ার সময় বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল মোট ঋণের ৫ শতাংশ আর ২০১৪ সাল শেষে তা দাঁড়ায় ৬৮ শতাংশে। কেলেঙ্কারির পর এখন পর্যন্ত বেসিক ব্যাংককে বাজেট থেকে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা দিয়েছে সরকার। কিন্তু ব্যাংকটি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। গত জুন পর্যন্ত বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ২৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৬৩ শতাংশ।

বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই ব্যাংকের কোনো কর্মী নন। তিনি সরকারের নিয়োগ পাওয়া পর্ষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। ফলে ব্যাংকের দিক থেকে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার বাস্তবতা নেই।

বেসিক ব্যাংকে শেখ আবদুল হাই কী করেছেন, তা দেশবাসী এখন জানে, সরকারও জানে। এত দিন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণেই যে তাঁর বিরুদ্ধে কিছু হয়নি, এটা পরিষ্কার।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান

বাচ্চুর আরও সম্পত্তি

বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকার সময় ২০১২ সালে শেখ আবদুল হাই ১১০ কোটি টাকা দিয়ে ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট বাজার এলাকার শহীদ সরণিতে ৩০ দশমিক ২৫ কাঠা জমির একটি বাড়ি কিনেছিলেন। দুটি দলিলে এর দাম দেখানো হয় ১৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, একক কর্তৃত্বে নামে-বেনামে ঋণ দিয়ে সেসব ঋণের একটি অংশ ঘুষ হিসেবে নিয়েছেন তিনি ও তাঁর ভাই শেখ শাহরিয়ার ওরফে পান্না।

এ বাড়ি কেনাকে কেন্দ্র করে এ বছরের ৩ অক্টোবর ৯৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে মামলা করেছে দুদক।

২০০৯ সালে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান হওয়ার এক বছর দুই মাস পরই শেখ আবদুল হাইয়ের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান ইডেন ফিশারিজের নামে ছয়টি এবং তাঁর ভাই শেখ শাহরিয়ার ওরফে পান্নার প্রতিষ্ঠান ক্রাউন ফিশারিজের নামে কেনা হয় দুটি জাহাজ। এসব জাহাজের বাজারদর প্রায় ১০০ কোটি টাকা।

বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলার আড়ুয়াঢিহি গ্রামে মা–বাবার নামে নতুন করে বাড়ি করেছেন শেখ আবদুল হাই। দোতলা এ বাড়ির নাম ‘শেখ হামিদ ও ছাবেদা ভিলা’।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বেসিক ব্যাংকে শেখ আবদুল হাই কী করেছেন, তা দেশবাসী এখন জানে, সরকারও জানে। এত দিন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণেই যে তাঁর বিরুদ্ধে কিছু হয়নি, এটা পরিষ্কার।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করা সম্পদ, জমি কেনা ইত্যাদি আয়কর বিবরণীতে তিনি দেখিয়েছিলেন কি না, তার পরীক্ষা হতে পারে। এরপর দুর্নীতি প্রমাণিত হলে এ সম্পদ জব্দ করতে পারে সরকার।