গত এক যুগে বাংলাদেশের আর্থিক খাত অনেক বড় হয়েছে। এই সময়ে নতুন ১৩টি ব্যাংক ও ৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়েছে এ খাতে। আবার বিকাশ, রকেট ও নগদের মতো মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান চালু হয়েছে ১৩টি। নতুন এসব প্রতিষ্ঠান যুক্ত হওয়ার ফলে বহুসংখ্যক মানুষ আর্থিক সেবার আওতায় এসেছে।
এতে গত এক যুগে ব্যাংকের আমানত ও ঋণ বেড়ে প্রায় তিন গুণ হয়েছে। তবে গ্রাহকের আমানতের সুরক্ষা ও ব্যাংকের ঋণ তদারকির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তা সেই তুলনায় খুব বেশি বাড়েনি। আবার যেটুকু জনবল রয়েছে, তাদেরও যথাযথভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না। ফলে আর্থিক খাতের তদারকি ক্রমেই দুর্বল হয়েছে।
তদারকি দুর্বলতা ও ব্যাংক খাতের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে গত ১৫ বছরে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২২ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। আর গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে না পারা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও বেড়েছে। এতে গ্রাহকের আমানতের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ সময়ে অর্থ পাচারও বেড়েছে ব্যাপকভাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী প্রথম আলোকে বলেন, গত দেড় দশকে আর্থিক খাত বেশ বড় হয়েছে। আমানত ও ঋণ দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে দক্ষ ও যোগ্য জনবল বাড়ানো প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেটি হয়নি, এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। বর্তমান পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ বিশেষ খাতে দক্ষ কর্মকর্তা নিয়োগ জরুরি হয়ে পড়েছে। যাঁরা অনিয়ম প্রতিরোধ, সময়োপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন, অর্থ পাচার প্রতিরোধ, ডিজিটাল লেনদেনের নীতিমালা প্রণয়ন ও তদারকিতে বিশেষ পারদর্শী হবেন। পাশাপাশি আমানতকারীদের সুরক্ষা দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বাংলাদেশের অর্থ পাচার প্রতিরোধে মূল সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বা বিএফআইইউ। এটি স্বতন্ত্র ইউনিট হলেও পরিচালিত হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দিয়ে। গভর্নর এই ইউনিটের রিপোর্টিং প্রধান। এই ইউনিট শুধু ব্যাংক থেকে অর্থ পাচার নয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শেয়ারবাজার এমনকি স্বর্ণের বাজারের অর্থ পাচার বিষয়েও অনুসন্ধান করে থাকে। পাশাপাশি বাংলাদেশের কোনো নাগরিক বিদেশে অর্থ পাচার করেছে কি না, সে বিষয়ে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে।
তবে অর্থ পাচার প্রতিরোধে এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো সফলতা দেখাতে পারেনি ইউনিটটি। এমনকি ডলার-সংকটের জন্য অর্থনীতিবিদেরা অর্থ পাচারকে দায়ী করলেও পাচার ঠেকাতে তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। জনবল কাঠামো অনুযায়ী, বিএফআইইউতে ১০২ জন কর্মকর্তা থাকার কথা। তবে বর্তমান জনবল আছে ৭৫ জন।
দেশের ৩৬টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১০টির বেশি আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। এর মধ্যে পাঁচটির সঙ্গে যুক্ত ছিল আর্থিক খাতের কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তদারকির দায়িত্বে রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগ। এ বিভাগের জনবল কাঠামো অনুযায়ী, জনবল থাকার কথা ৭০ জন, আছে ৪৫ জন।
একই অবস্থা ব্যাংকিং নীতি প্রণয়ন, ব্যাংক তদারকি, ব্যাংক পরিদর্শনসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিটি বিভাগে। ফলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তদারকিতে দুর্বলতা দেখা দিয়েছে।
অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাঁচটি বিভাগের দায়িত্বে থাকা একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, জনবল-সংকটের মধ্যেও ব্যাংকগুলোর যেসব অনিয়ম ও দুর্নীতি ধরা হচ্ছে, সেগুলোর বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। বেশি কর্মকর্তা দিয়ে আরও বেশি অনিয়ম ধরা হলে তাতে কী উপকার হতো, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
গত এক বছরে প্রচলিত ধারার একটি ব্যাংকের অনিয়ম ধরার ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। এ কারণে অনেকে এখন ব্যাংকের অনিয়ম ধরতে খুব বেশি আগ্রহী হচ্ছেন না।
২০১২ সালের পর আর্থিক খাতে যুক্ত হয়েছে নতুন ১৩টি ব্যাংক। এগুলো হলো মধুমতি ব্যাংক, মেঘনা ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, কমিউনিটি ব্যাংক, সীমান্ত ব্যাংক, বেঙ্গল ব্যাংক ও সিটিজেন ব্যাংক। আর্থিক প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়েছে তিনটি, এগুলো হলো অ্যালায়েন্স ফাইন্যান্স, মেরিডিয়ান ফাইন্যান্স ও স্ট্র্যাটেজিক ফাইন্যান্স।
এর বাইরে এ সময়ে এই খাতে যুক্ত হয়েছে মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা ১৩টি প্রতিষ্ঠান। আর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে দুটি পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল ব্যাংকের। তাতে পুরো খাতের আকারও বেশ বেড়েছে।
২০১৪-১৫ অর্থবছর শেষে ব্যাংক খাতে আমানত ছিল ৭ লাখ ৪৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ও ঋণ ছিল ৫ লাখ ৫২ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মী ছিলেন ৬ হাজার ৬৭ জন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংকে আমানত বেড়ে হয়েছে ১৬ লাখ ৯৭ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা। আর ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৭২ হাজার ৮০৯ কোটি টাকা। গত অর্থবছর শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মীর সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৬০ জনে।
২০১২ সালে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৪২ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা। সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা যায়, ব্যাংকিং খাতে স্ট্রেসড অ্যাসেটস বা দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ ৪ লাখ কোটি টাকার। খেলাপি ঋণ, ঋণ অবলোপন, ঋণ পুনঃ তফসিল, ঋণ পুনর্গঠন এবং মামলায় আটকে থাকা ঋণকে একসঙ্গে স্ট্রেসড অ্যাসেটস বা দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ বলা হয়।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যথাযথ তদারকি করলে এই বিপুল পরিমাণ ঋণ দুর্দশাগ্রস্ত হতো না। এর বাইরে আরও বহু ঋণের পরিস্থিতি একই রকম, যা এখনো হিসাবে আসেনি। শরিয়াহ ব্যাংকগুলোর অনিয়ম হিসাবে নিলে যা দ্বিগুণ হয়ে যাবে।
সার্বিক বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বক্তব্য জানতে মুখপাত্র মেজবাউল হককে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।