সব ব্যাংক আমদানি দায় নিষ্পত্তিতে ডলারের দাম ৯৫ টাকা ৫ পয়সা নির্ধারণ করে রেখেছে। তবে বাস্তবে তা মানছে না।
ব্যাংকগুলো আমদানি দায় নিষ্পত্তির (বিসি সেল) ক্ষেত্রে ডলারের যে দাম ঘোষণা করছে, তা মানছে না। নিজেদের ঘোষিত দামের চেয়ে আমদানিকারকদের কাছ থেকে বেশি টাকা আদায় করছে তারা। ফলে ঘোষণার সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল থাকছে না। এতে পণ্য আমদানির খরচ বেড়ে যাচ্ছে। আর এই চাপ গিয়ে পড়ছে ভোক্তাদের ওপর। কারণ, তাঁদের বেশি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে। এভাবেই কয়েক মাস ধরে চলে আসছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক শুধু সরকারি জ্বালানি ও জরুরি খাদ্য আমদানির দায় মেটানোর ক্ষেত্রেই প্রতি ডলার ৯৫ টাকা দামে বিক্রি করছে, যা আগে ছিল ৮৬ টাকা। কিন্তু আন্তব্যাংক দামে কোনো ডলার লেনদেন হচ্ছে না। কার্যত ব্যাংকগুলোতে ১০০ টাকার নিচে কোনো ডলার মিলছে না। যে কারণে ডলারের বাজার নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা পদক্ষেপের পরও পণ্য আমদানির খরচ কমছে না, বরং গত মে মাস থেকে তা বেড়ে গেছে। সেই তুলনায় কিন্তু রপ্তানি আয় বাড়েনি। কমে গেছে প্রবাসী আয়ও।
ডলারের দামের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে স্বচ্ছ হতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককেও দাম ধরে না রেখে কিছুটা ছাড়তে হবে। যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা কাজে দিয়েছে। ফলে এসব অব্যাহত রাখতে হবে।সালেহউদ্দিন আহমেদ সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
এ রকম পরিস্থিতিতে ডলারের সংকট সামলাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তথা মজুত থেকে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে রিজার্ভের পরিমাণ ৪৮ বিলিয়ন তথা ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার থেকে কমে হয়েছে ৩ হাজার ৯০০ কোটি ডলার (৩৯ বিলিয়ন)।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলাকে বলেন, ‘ব্যাংক ডলারের যে দাম ঘোষণা করবে, সেই দামই নিতে হবে। দাম গোপনের কোনো সুযোগ নেই। এমনটা হলে আমরা দেখব।’
বেসরকারি খাতের চারটি ব্যাংকের মাধ্যমে পণ্য আমদানি করে থাকেন, এমন একজন উদ্যোক্তার মাধ্যমে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার ওই সব ব্যাংকে ডলারের প্রকৃত দামের খোঁজ নেয় প্রথম আলো। কারণ, প্রতিবেদক হিসেবে খোঁজ নিলে প্রকৃত তথ্য দেয় না ব্যাংকের শাখাগুলো। আমদানিকারকদের কাছ থেকে বিলের বিপরীতে ব্যাংক যে টাকা আদায় করে, সেটিই ডলারের প্রকৃত দাম। ফলে ব্যাংকগুলোর ঘোষণা ও প্রকৃত দামের মধ্যে বিস্তর ফারাক লক্ষ্য করা যায়। অন্যান্য ব্যাংকের অবস্থাও একই।
ওই চার ব্যাংক গত বুধবার আমদানি দায় নিষ্পত্তিতে প্রতি ডলারের দাম নিয়েছে যথাক্রমে ১০৬ টাকা ৬০ পয়সা, ১০৬ টাকা, ১০৫ টাকা ও ১০১ টাকা নেয়। বৃহস্পতিবারও এর চেয়ে ১০-২০ পয়সা হেরফেরে তারা ডলার বিক্রি করে। অন্য ব্যাংকগুলোও আমদানিতে কাছাকাছি দাম রেখেছে বলে জানা যায়।
ব্যাংক খাতের শীর্ষ কর্মকর্তারা এখন ডলারের বাজার নিয়ে কথা বলতে চাইছেন না। দুটি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংক ডলার পায় প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয় থেকে। প্রবাসী আয় আনতে ডলার কিনতে হচ্ছে ১০৬-১০৭ টাকায়। আর রপ্তানি বিল নগদায়নে ১০১-১০২ টাকা দিতে হচ্ছে। গড়ে ডলারের যে দাম আসছে, তাই ধরা হচ্ছে। আগে কিছুটা লাভ করে দাম ঠিক করা হতো, এখন আর সেই লাভ ধরা হয় না। ফলে ডলারে যে খরচ হচ্ছে, আমদানিকারকদের কাছে তা-ই আদায় করা হচ্ছে।
তাহলে ঘোষিত দাম কম দেখানো হচ্ছে কেন, এই প্রশ্নের জবাবে তাঁরা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম ৯৫ টাকায় আটকে রেখেছে। ব্যাংকগুলো ১০৫ টাকা দেখালে তা ভালো দেখায় না। তবে আদায় করলে কোনো সমস্যা না। এসব দাম ‘করপোরেট ডিল’ বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্যের পাশাপাশি ডলারের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। ফলে মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠেছে। তবে সবাই যে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিতে পারছেন, তা-ও নয়। বিশেষ করে ডলারের দাম বাড়ায় ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা বেশ চাপে পড়েছেন। তাঁরা বলছেন, চাইলেও পণ্যের দাম বাড়ানো যাচ্ছে না। কিন্তু খরচ ঠিকই বেড়ে গেছে। এমন একজন উদ্যোক্তা প্লাস্টিক খাতের সৈয়দ নাসির। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্লাস্টিকের কাঁচামাল এনে চাহিদামতো কনটেইনার তৈরি করে দিই। যে হারে খরচ পড়ছে, সেই হারে উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়াতে পারছি না। যাঁরা আমার ক্রেতা, তাঁরা ডলারের হিসাব করছেন ৯৫ টাকা ধরে। কে কাকে বোঝাবে, কিছুই বুঝতে পারছি না। ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। ব্যবসায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।’
সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের চাপ সামলাতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। আমদানিতে লাগাম টানতে মার্জিন বাড়ানো হয়েছে, অনেক পণ্য আমদানিতে ব্যাংকঋণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আবার ব্যাংকগুলোকে ৩০ লাখ ডলারের বেশি মূল্যের ঋণপত্রের তথ্য ২৪ ঘণ্টা আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে বলা হয়েছে। এসব ঋণপত্র মূল্য খতিয়ে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে আমদানির চাপ অনেকটা কমেছে। গত জুনের তুলনায় জুলাইয়ে ঋণপত্র (এলসি) খোলা ও তা নিষ্পত্তির হার দুটোই কমেছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারে অতিরিক্ত মুনাফা করায় বেসরকারি পাঁচটি ও একটি বহুজাতিক ব্যাংকের ট্রেজারিপ্রধানকে সম্প্রতি দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়। ব্যাখ্যা দিতে এসব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদেরও (এমডি) নোটিশ দেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলো ক্ষমা চেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চিঠি পাঠিয়েছে।
ডলার-সংকটের কারণে চাপে পড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুতও। কারণ, গত মে মাস থেকে রিজার্ভ থেকে ধারাবাহিকভাবে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে। ফলে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন থেকে কমে হয়েছে ৩৯ বিলিয়ন ডলার। চলতি সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নে (আকু) প্রায় ১৭৩ কোটি ডলারের দায় শোধ করতে হবে। ফলে রিজার্ভ কমে ৩৭ বিলিয়নে নেমে আসবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ডলারের দামের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে
স্বচ্ছ হতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককেও দাম ধরে না রেখে কিছুটা ছাড়তে হবে। যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা কাজে দিয়েছে। ফলে এসব অব্যাহত রাখতে হবে।