নতুন পর্ষদ এস আলম গ্রুপের চট্টগ্রাম ও রাজশাহীর বিভিন্ন প্রকল্প পরিদর্শন করে ঋণ আদায়ের উদ্যোগ নেয়।
এমডিসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা অনলাইনে এস আলমের সঙ্গে সভা করেন।
এস আলম সাড়া না দেওয়ায় তাদের ঋণগুলো খেলাপি হতে শুরু করেছে।
গ্রুপটি প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়, যা এই ব্যাংকের মোট ঋণের ৫০ শতাংশ।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েই সেটি থেকে এস আলম গ্রুপ ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ বের করে নেয়। এ অর্থ ব্যাংকটির মোট ঋণের প্রায় ৫০ শতাংশ। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ইসলামী ব্যাংকের নতুন পরিচালনা পর্ষদ দায়িত্ব নিয়ে গ্রুপটির চট্টগ্রাম ও রাজশাহীর বিভিন্ন প্রকল্প পরিদর্শন করে ঋণ আদায়ে উদ্যোগী হয়।
ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা কমিটি এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলমের সঙ্গে অনলাইনে সভা করে। এরপরও ঋণ পরিশোধের বিষয়ে কোনো সাড়া দিচ্ছেন না সাইফুল আলম। ফলে এসব ঋণ খেলাপি হতে শুরু করেছে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংক দখল করে নেয়। এরপর পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন এনে নামে-বেনামে ব্যাংকটি থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা তুলে নেয় গ্রুপটি। পাশাপাশি গ্রুপের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামেও ঋণ অনুমোদন করা হয়। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ২২ আগস্ট ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে নতুন পর্ষদ গঠন করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী প্রথম আলোকে বলেন, গ্রাহকের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ঋণ আদায়ের পথ বের করা গেলে ভালো হতো। তারা যেহেতু টাকা নিয়েছে, সেহেতু তাদেরই আলোচনা করার তাগিদ থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তাদের ক্ষমতা এত বেশি যে কোনো কিছুকেই তারা ভয় পায় না। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারকে ঠিক করতে হবে কোন উপায়ে টাকা আদায় করা হবে।
মোস্তফা কে মুজেরী আরও বলেন, টাকা আদায়ে আইনি প্রক্রিয়ার মানে হলো বিষয়টি হিমঘরে চলে যাওয়া। এ জন্য এই টাকা আদায়ে মামলা হলে উচ্চ আদালতে বিশেষ বেঞ্চ গঠন করা যেতে পারে, যাতে দ্রুততম সময়ে সঠিক বিচার হয়। এ ঘটনার সঠিক বিচার হলে তা অন্য ঋণখেলাপিদের কাছে একটি কড়া বার্তা যাবে।
প্রকল্প পরিদর্শনে পরিচালনা পর্ষদ
ইসলামী ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল-মাসুদের নেতৃত্বে পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা দায়িত্ব নেওয়ার পর ঋণ আদায়ে চট্টগ্রামে এস আলম গ্রুপের প্রধান কার্যালয় ও বিভিন্ন কারখানা পরিদর্শন করেন। এ সময় গ্রুপটির নির্বাহী পরিচালক ও মহাব্যবস্থাপক পদমর্যাদার কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকলেও তাঁরা ঋণের বিষয়ে কোনো কথা বলেননি।
বিভিন্ন নথিপত্রে দেখা গেছে, ইসলামী ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপের সরাসরি নেওয়া ঋণের পরিমাণ ৫৬ হাজার ১১৮ কোটি টাকা। তবে এই ব্যাংক থেকে গ্রুপটির নেওয়া পরোক্ষ ঋণের পরিমাণ ৭ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা। এসব ঋণ দেওয়া হয়েছে ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ, ওআর নিজাম রোড ও পাহাড়তলী এবং রাজধানীর গুলশান ১ নম্বর শাখা থেকে।
যদিও ইসলামী ব্যাংক কোনো ব্যবসায়ী গ্রুপকে সর্বোচ্চ ৫০০ কোটি টাকা ঋণ দিতে পারে। তবু তারা সেই সীমা লঙ্ঘন করে অনেক বেশি দিয়েছে।
তারা যেহেতু টাকা নিয়েছে, সেহেতু তাদেরই আলোচনা করার তাগিদ থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তাদের ক্ষমতা এত বেশি যে কোনো কিছুকেই তারা ভয় পায় না। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারকে ঠিক করতে হবে কোন উপায়ে টাকা আদায় করা হবে।মোস্তফা কে মুজেরী, সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংক
এস আলমের সঙ্গে সভা
সাইফুল আলম প্রায় আট বছর ইসলামী ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁর সঙ্গে নতুন পরিচালনা পর্ষদের নির্দেশে নভেম্বরের শুরুতে অনলাইনে সভা করেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলাসহ শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা। এ সময় ব্যাংকে এস আলম গ্রুপের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা সুব্রত কুমার ভৌমিক সশরীর উপস্থিত ছিলেন। সভায় ইসলামী ব্যাংকের পক্ষ থেকে এস আলমকে জানানো হয়, ব্যাংকে তাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ঋণ প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা। এসব ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ছে। ফলে ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংক চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
সভায় তাঁকে এ যাত্রা ১০ হাজার কোটি টাকা ফেরত দিতে বলা হয়েছে। এর জবাবে এস আলমের পক্ষে বলা হয়, ব্যবসা চালু রাখার সুযোগ পেলে তিনি তাঁর নামে থাকা টাকা ফেরত দেবেন। তবে অন্য ঋণের বিষয়ে তাঁর জানা নেই।
এ সময় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, ১০০ টাকা ফেরত দিলে ২০ টাকা জমা করে ৮০ টাকা ঋণ দেওয়া হবে। এতে ব্যবসাও চলবে, ঋণও ধীরে ধীরে আদায় হবে।
এরপর প্রায় দেড় মাস হয়ে গেলেও এস আলম গ্রুপের পক্ষ থেকে আর কোনো সাড়া পায়নি ব্যাংক। এদিকে গ্রুপটির নেওয়া বেশির ভাগ ঋণ খেলাপি হতে শুরু করেছে বলে জানান ব্যাংকটির কর্মকর্তারা।
এ নিয়ে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাইফুল আলম ও সুব্রত কুমার ভৌমিক কোনো সাড়া দেননি।
জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ঋণের প্রকৃত হিসাব ব্যাংকের নথিতে তুলে ধরা শুরু হয়েছে। ফলে ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ হু হু করে বাড়ছে। গত জুনে ইসলামী ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ছিল ৭ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা, যা সেপ্টেম্বরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা; অর্থাৎ তিন মাসেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ২৭ কোটি টাকা।
অপেক্ষা নিরীক্ষা প্রতিবেদনের জন্য
নতুন পরিচালনা পর্ষদ দায়িত্ব নিয়ে চারটি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানকে (সিএ ফার্ম) ইসলামী ব্যাংকের ঋণের প্রকৃত চিত্র, সুবিধাভোগী, জামানতের মূল্য ও লোকবল নিয়োগ খতিয়ে দেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এসব প্রতিষ্ঠান চলতি মাসেই চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেবে বলে ব্যাংকটিকে জানিয়েছে। তাদের সাময়িক প্রতিবেদনেও ৭৩ হাজার কোটি টাকার ঋণের তথ্য উঠে আসে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ইসলামী ব্যাংক ইতিমধ্যে নিশ্চিত হয়েছে যে এস আলম গ্রুপ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কোনো টাকা ফেরত দেবে না। তাদের কাছ থেকে ঋণ আদায়ে আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া এখন আর কোনো পথ খোলা নেই। সে জন্য কর্তৃপক্ষ আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবছে। এ জন্য সিএ ফার্মের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে।
ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেন, নামে-বেনামে এস আলমের যেসব সম্পদ আছে, সেগুলো বিক্রি করে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ব্যাংকের হিসাবে গ্রুপটির সম্পদের মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও গাজীপুরে বিপুল জমি, একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র, বিভিন্ন কারখানা ও প্রতিষ্ঠানের শেয়ার রয়েছে।
কেবল একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী যেভাবে একটি ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা লুটপাট করেছে, তা দেশের সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি হিসেবে ইতিমধ্যেই পরিচিত পেয়েছে। এ লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে তৎকালীন আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ সমর্থনে। ইসলামী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংক থেকে ঋণ বের করার ক্ষেত্রে আর্থিক খাতের আইনকানুন ও নিয়মনীতির বড় ধরনের ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে।
এসব নিয়ে জানতে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ফোন করা হলেও তাঁরা সাড়া দেননি।