বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মেহমুদ হোসেন পদত্যাগ করেছেন। গত বুধবার ‘ব্যক্তিগত কারণ’ দেখিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে তিনি ব্যাংক থেকে বের হয়ে যান। এরপর বৃহস্পতিবার আর ব্যাংকে যাননি। এমডি পদে তাঁর মেয়াদ ছিল আগামী ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
ব্যাংক খাতের কয়েকটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, পদত্যাগপত্রে ‘ব্যক্তিগত কারণ’ উল্লেখ করলেও তাঁকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। গত সোমবার সন্ধ্যায় তাঁকে বনানীর ১১ নম্বর সড়কের সিকদার হাউসে ডেকে নেওয়া হয়। এরপরই তিনি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। মেহমুদ হোসেন পদত্যাগ করায় ব্যাংকটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) সৈয়দ রইস উদ্দিনকে ভারপ্রাপ্ত এমডির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ন্যাশনাল ব্যাংকের আগে মেহমুদ হোসেন এনআরবি ব্যাংক ও ব্যাংক এশিয়ার এমডি ছিলেন। এর আগে ছয় বছরে চারজন এমডিকে মেয়াদ শেষের আগেই ব্যাংকটি থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল।
মেহমুদ হোসেন পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মনোয়ারা সিকদারের কাছে। মনোয়ারা সিকদার অসুস্থ, যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে দেড় মাস ধরে চিকিৎসাধীন। তবে পদত্যাগের বিষয়ে জানতে নানা মাধ্যমে যোগাযোগ করেও মেহমুদ হোসেনের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সৈয়দ রইস উদ্দিনকেও ফোনে পাওয়া যায়নি।
ন্যাশনাল ব্যাংকে নানা অনিয়ম ও এমডির পদত্যাগের ঘটনা নতুন নয়। গত দেড় দশকে ব্যাংকটির বেশির ভাগ এমডিই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। যে কারণে ২০১৪ সালে ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন ব্যাংকটিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন সমন্বয়ক দায়িত্ব পালন করলেও ব্যাংকটির অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। ব্যাংকটির মালিকানায় রয়েছে সিকদার গ্রুপ। তারাই ব্যাংকটির নানা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকটিতে যে সুশাসন ও জবাবদিহি নেই, এভাবে একের পর এক এমডি বিদায় নেওয়ার মাধ্যমে তা প্রমাণিত হচ্ছে। আমানতকারীদের স্বার্থে ব্যাংকটিতে এখনই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ করা দরকার। প্রয়োজনে পর্ষদ ভেঙে দিতে হবে। এমনিতেই কয়েকটি ব্যাংকে বড় অনিয়ম হচ্ছে, এই সময়ে কোনো এমডির এভাবে বিদায় কাম্য হতে পারে না। এর প্রভাব পুরো খাতের ওপর পড়বে।
এমডিদের সুরক্ষায় ২০১৪ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রজ্ঞাপন জারি করে বলেছিল, মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে কেউ স্বেচ্ছায় পদ ছাড়তে চাইলে এক মাস আগে পদত্যাগের কারণ জানিয়ে নিজ ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া কারও চুক্তি বাতিল বা কাউকে পদত্যাগে বাধ্য করা যাবে না।
তবে এই প্রজ্ঞাপন জারির পর ন্যাশনাল ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের এমডি পদত্যাগ করেন। এতে এই নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, বরং পরের এমডিকে দ্রুত অনুমোদন দিয়েছে। ফলে এই নির্দেশনা প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার সম্প্রতি ব্যাংক এমডিদের সঙ্গে এক সভায় বলেছেন কোনো অনিয়মের চাপ এলে তা বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে। বাংলাদেশ ব্যাংক এমডিদের সুরক্ষা দেবে। এরপরও যাতে অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করা না হয়।
তবে ব্যাংক এমডিরা এতে ভরসা করতে পারছেন না। কারণ, কয়েকটি ব্যাংকের মালিকপক্ষের কাছে বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যত জিম্মি। এসব ব্যাংকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নিতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক প্রথম আলোকে বলেন, ন্যাশনাল ব্যাংকের এমডির পদত্যাগসংক্রান্ত কোনো বিষয় এখনো জানি না। তবে পদত্যাগ করতে হলে এক মাস আগে জানানোর নিয়ম রয়েছে।
নানা অনিয়মের কারণে দুই বছর ধরে ন্যাশনাল ব্যাংক নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ প্রদান নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আবার তুলেও নিয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংকটি চট্টগ্রামের একটি গ্রুপের সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা সুদ মওকুফ করেছে। এর ফলে ন্যাশনাল ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়। মাঝেমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী নগদ জমা (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ জমার (এসএলআর) অর্থ রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। এ জন্য গুনছে জরিমানা। এর মধ্যে মেহমুদ হোসেনকে ছাড়াই চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ব্যাংকটির পর্ষদ সভায় ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের ঋণ নবায়ন করা হয়। সেদিনই গ্রাহক ব্যাংক থেকে ২২ কোটি টাকা তুলে নেন। এরপর আরও কয়েকজন গ্রাহকের ঋণ প্রস্তাব পর্ষদে পাঠানোর জন্য এমডির ওপর সিকদার পরিবারের দুই সদস্য চাপ তৈরি করেন বলে জানা গেছে। তবে মেহমুদ হোসেন এতে রাজি ছিলেন না।
এমন পরিস্থিতিতে গত সোমবার মেহমুদ হোসেনকে সিকদার পরিবারের বনানীর বাসায় ডেকে পাঠানো হয়। এ সময় রন হক সিকদার ও রিক হক সিকদার সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ওই সময় মেহমুদ হোসেনের মুঠোফোনে যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় বলে একটি সূত্র জানায়। এরপর মঙ্গলবার তিনি অফিস করেন। বুধবার সব বিভাগের প্রধানদের সঙ্গে সভা করেন। এরপর পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে ব্যাংক থেকে বেরিয়ে যান।
ন্যাশনাল ব্যাংক এখন সিকদার পরিবারের নিয়ন্ত্রণে। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছাড়াও পরিচালক পদে রয়েছেন এ পরিবারের সদস্য পারভীন হক সিকদার, রন হক সিকদার, রিক হক সিকদার। এ ছাড়া সিকদার ইনস্যুরেন্সের পক্ষে রয়েছেন শফিকুর রহমান। এর বাইরে রয়েছেন চট্টগ্রামের কেডিএস গ্রুপের খলিলুর রহমান ও আরমানা গ্রুপের জাকারিয়া তাহের। এ ছাড়া স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে রয়েছেন সিকদার গ্রুপের কর্মকর্তা নাইমুজ্জামান ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর মুরশিদ কুলি খান।