ফেডের অনুসরণে অন্যান্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে এবং
অনিয়ন্ত্রিত ডলারের প্রভাবে অন্যান্য দেশের মুদ্রার অবনমন, এটাই বাস্তবতা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। এটাই অর্থনীতির চিরাচরিত ধারণা। কিন্তু কপি বুক বোধ হয় সব সময় অন্ধের মতো অনুসরণ করা যায় না। বাস্তবতা বুঝে করতে হয়। বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়াই করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর নীতি সুদহার বৃদ্ধির হিড়িকের পরিপ্রেক্ষিতে যে মন্দার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে এমন কথা বলছেন বিশ্লেষকেরা।
বিষয়টি হলো, পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী অর্থনীতির ততোধিক প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ নীতি সুদহার বাড়িয়ে চলেছে। কিন্তু বিশ্বায়নের যুগে তার প্রভাব শুধু সে দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, সেই প্রভাব গড়িয়ে পড়ছে বিশ্বের প্রায় সর্বত্র।
ফেডের অনুসরণে অন্যান্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে এবং অনিয়ন্ত্রিত ডলারের প্রভাবে অন্যান্য দেশের মুদ্রার অবনমন—এটাই এখন বাস্তবতা। ফলে অনেকেই বলছেন, এখন যে বিশ্বজুড়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে, তা মূলত ডলারবাহিত মূল্যস্ফীতি।
ডলার তো আর শূন্যের মধ্যে শক্তিশালী হয় না, তাকে তো কোনো না কোনো কিছুর সাপেক্ষে শক্তিশালী হতে হয়।জেমস অ্যাশলি সিএনএনকে, আন্তর্জাতিক বাজারবিষয়ক কৌশলবিদ, গোল্ডম্যান স্যাকস
ফেডের প্রভাব অন্যান্য দেশেও পড়ছে। কারণ, তারা যদি ফেডের পেছনে পড়ে যায়, তাহলে বিনিয়োগকারীরা তাদের দেশ থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিতে পারে আর তাতে মহাবিপদ। সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় মার্কিন ডলার সে দেশেই জমা রাখা লাভজনক, নিরাপদ।
ফলে ভারতের মতো বাজার থেকে বিনিয়োগ তুলে নেওয়ার ঢল পড়েছে। ফেডের অনুসরণে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড, সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, নরওয়ে, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, তাইওয়ান, নাইজেরিয়া, ফিলিপাইন, ভারত ও বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বৃদ্ধি করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবারসহ এ বছর সব মিলিয়ে তিনবার নীতি সুদহার বৃদ্ধি করেছে।
ফেডারেল রিজার্ভের এ নীতি সুদহার বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় সুফল হলো ডলারের বিনিময় মূল্য বৃদ্ধি পাওয়া। প্রভাবশালী মুদ্রাগুলোর মধ্যে ডলারের বিনিময় মূল্য এখন গত ২০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এতে মার্কিন নাগরিকদের সুবিধা হলেও অনেক দেশের অবস্থা তথৈবচ। আমদানি মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশ, ভারতসহ অনেক উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশ বিপাকে পড়েছে।
গোল্ডম্যান স্যাকসের আন্তর্জাতিক বাজারবিষয়ক কৌশলবিদ জেমস অ্যাশলি সিএনএনকে বলেন, ডলার তো আর শূন্যের মধ্যে শক্তিশালী হয় না, তাকে তো কোনো না কোনো কিছুর সাপেক্ষে শক্তিশালী হতে হয়।
বিষয়টি অন্যান্য দেশের জন্য রীতিমতো শাস্তিমূলক হয়ে উঠেছে। ফেডের এ নীতি সুদ বৃদ্ধির হিড়িকে জাপানের মতো দেশও সম্প্রতি ইয়েনের দর বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়েছে—২৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। অথচ জাপানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশ্বের অন্যান্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যে ব্যতিক্রম ছিল, তারা এত দিন নীতি সুদহার বৃদ্ধি করেনি। অথচ তারাও শেষমেশ তা করতে বাধ্য হলো।
এ পরিস্থিতিকে বিশ্লেষকেরা প্রেশার কুকারের সঙ্গে তুলনা করছেন। এ পরিস্থিতিতে যথাযথ নীতি প্রয়োজন, কোনো ধরনের ব্যত্যয় হলে তার জন্য শাস্তি পেতে হবে।
গ্লোবাল টাইমস-এর এক সংবাদে বলা হয়েছে, এবারের বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ডলারবাহিত মূল্যস্ফীতি। ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময় থেকেই এর সূত্রপাত। করোনা মহামারি মোকাবিলায় আমেরিকান সরকার সে দেশের জনগণকে বিপুল পরিমাণ প্রণোদনা দিয়েছে। এ অর্থের জোগান নিশ্চিত করতে তারা যেমন একদিকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছে, তেমনি সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ বিপুল পরিমাণ মুদ্রা ছেপেছে। আর সেই ডলারের হাত ধরে মূল্যস্ফীতি দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, এমন কথাই বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্র তার আগের কয়েক দশকের তুলনায় অনেক গুণ বেশি ডলার ছেপেছে—১৮ ট্রিলিয়ন বা ১৮ লাখ কোটি ডলার। অতিরিক্ত ডলারের কারণে সারা পৃথিবীতে সৃষ্টি হয়েছে মুদ্রাস্ফীতি। অনেকের অভিযোগ, ইউক্রেনে যুদ্ধ বাধিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার অভ্যন্তরীণ বাজারের মূল্যস্ফীতি বিদেশে রপ্তানি করেছে। গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো এসেছিল কোভিড বিপর্যয়। মন্দার কারণে গরিব দেশগুলোর রপ্তানি ও আয় কমে গিয়ে তাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে ডলারের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে।
২০০৭-২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের আগেও যুক্তরাষ্ট্রে নীতি সুদহার কম ছিল। তার পরিণতিতে বন্ধকি ঋণের সংকটে পড়ে তারা। কিন্তু সে দেশের নীতিপ্রণেতারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেননি বলেই অভিযোগ করছেন বিশ্লেষকেরা।
বলছেন, এবারও কোভিড-১৯ মহামারির ধকল কাটিয়ে উঠতে নীতি সুদহার কম রাখা হয়েছে দীর্ঘদিন। শুধু তা-ই নয়, ফেডারেল রিজার্ভ ট্রেজারি বন্ডসহ অন্যান্য সিকিউরিটিজ-সমর্থিত সম্পদ কিনেছে। এর মধ্য দিয়ে তারা বাজারে বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ সরবরাহ করেছে।
অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ মনে করেন, সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের যে ধারণা এত দিন বিশ্বব্যাপী প্রচলিত ছিল, তা ইতিমধ্যে ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। নীতি সুদের হার বাড়িয়েও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সামান্যতম সাফল্য মিলছে না, বরং এতে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিষয়টি বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিবিদদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকও একই সুরে কথা বলেছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো যেভাবে একযোগে সুদের হার বাড়াচ্ছে, তা গত পাঁচ দশকে আর দেখা যায়নি। এ প্রবণতা আগামী বছরও থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। বরং সরবরাহব্যবস্থা গতিশীল করা এবং ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নিরসনেই বেশি গুরুত্ব দেওয়ার পক্ষপাতী তারা।
বিনিয়োগকারীরা মনে করছেন, ২০২৩ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুদের হার বাড়িয়ে ৪ শতাংশ করবে, যা ২০০১ সালের গড় হারের দ্বিগুণের বেশি। ফলে মন্দা অবশ্যম্ভাবী।
এর আগে ১৯৮০-এর দশকে সর্বশেষ ডলারের এমন উল্লম্ফন দেখা গিয়েছিল। তখন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য সমন্বিতভাবে মুদ্রাবাজারে হস্তক্ষেপ করে, যাকে বলে প্লাজা অ্যাকর্ড। ডলারের এ তাণ্ডব নৃত্যের পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেই মনে করছেন, এখন আরও একটি এমন চুক্তির সময় এসেছে।
কিন্তু হোয়াইট হাউস এমন ধারণায় ঠান্ডা জল ঢেলে দিয়েছে সম্প্রতি। ফলে তেমন উদ্যোগের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। দেশটির জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের পরিচালক ব্রায়ান ডিস সম্প্রতি সিএনএনকে বলেছেন, ‘আমি মনে করি না, তেমন কোনো ঐকমত্যের দিকে আমরা এগোচ্ছি।’
তথ্যসূত্র: সিএনএন ও গ্লোবাল টাইমস