গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ইউনিয়ন ব্যাংকের যে হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছিল, তার মালিককে শেষ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া গেছে। বেসরকারি খাতের এই ব্যাংককে নির্বাচনের এক বছর আগে হিসাবটি খুলে জমা করা হয় নগদ টাকা। হিসাবধারী প্রতিষ্ঠানকে ঋণও দেয় ব্যাংক। এরপর নির্বাচনের আগে সেই হিসাব থেকে নগদ উত্তোলন করা হয় ৭২ কোটি টাকা। ভোটের পরপরই রহস্যময় এই হিসাবে লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়, আর এটি পুরোপুরি বন্ধ করা হয় রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গত ২০ আগস্ট।
মোস্তাক ট্রেডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের নামে হিসাবটি ২০২২ সালের ১৫ নভেম্বর খোলা হয়েছিল ব্যাংকের বনানী শাখায়। ব্যাংকে থাকা নথিপত্রে ঢাকার যে ঠিকানা ব্যবহার করা হয়, সেখানে ওই প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে যাঁর জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে হিসাবটি খোলা হয়েছিল, তাঁর সন্ধান পাওয়া গেছে।
ক্রিকেট থেকে চলচ্চিত্র তারকা, নবীন থেকে প্রবীণ প্রার্থীরাও ছিলেন এই তালিকায়। তাঁরা মনে করেন, নির্বাচনের খরচ চালাতে তৎকালীন সরকারের পক্ষে এই টাকা বিতরণের দায়িত্ব পেয়েছিলেন সাইফুল আলম। এ জন্য ইউনিয়ন ব্যাংকসহ তাঁর মালিকানায় থাকা আরও ব্যাংক থেকে বেনামি ঋণ নেওয়া হয়।
হিসাবটি খোলা হয় মোহাম্মদ মুশতাক মিঞার নামে। তাঁর বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়ায়। বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের প্রধান সাইফুল আলমের ব্যক্তিগত সচিব ও ইসলামী ব্যাংকের সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) আকিজ উদ্দিনের বাসায় রান্নার কাজ করেন মুশতাক মিঞা।
ইউনিয়ন ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন এমন অনেককে ও তাঁদের পক্ষের ব্যক্তিদের তাঁরা নির্বাচনের আগে এই হিসাব থেকে টাকা তুলতে দেখেছেন। ক্রিকেট থেকে চলচ্চিত্র তারকা, নবীন থেকে প্রবীণ প্রার্থীরাও ছিলেন এই তালিকায়। তাঁরা মনে করেন, নির্বাচনের খরচ চালাতে তৎকালীন সরকারের পক্ষে এই টাকা বিতরণের দায়িত্ব পেয়েছিলেন সাইফুল আলম। এ জন্য ইউনিয়ন ব্যাংকসহ তাঁর মালিকানায় থাকা আরও ব্যাংক থেকে বেনামি ঋণ নেওয়া হয়।
২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইউনিয়ন ব্যাংক এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অতি ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের পতনের পর ইউনিয়ন ব্যাংকসহ ৯টি ব্যাংককে এস আলমমুক্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নানা আর্থিক অপরাধের অভিযোগ আসার পর আত্মগোপনে গেছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ বি এম মোকাম্মেল হক চৌধুরীসহ ইউনিয়ন ব্যাংকের আরও কয়েকজন কর্মকর্তা।
চাল-ডালের ব্যবসা করতে ব্যাংকে হিসাব খোলা হয়েছিল। তবে ব্যবসা করা হয়নি। সরকার পরিবর্তনের পর আকিজ সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।মোহাম্মদ মুশতাক মিঞা
মোহাম্মদ মুশতাক মিঞার বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার হাজীর পাড়া গ্রামে। জাতীয় পরিচয়পত্রে তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা উল্লেখ করা হয়েছে মাধ্যমিক পাস। প্রথম আলোর একজন প্রতিনিধি ১৫ অক্টোবর দুপুরে মোহাম্মদ মুশতাক মিঞাকে তাঁর গ্রামের বাড়িতে দেখতে পান। এ সময় তাঁর ব্যবসা ও ব্যাংক হিসাব নিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি ইতস্তত বোধ করেন। সরে যাওয়ারও চেষ্টা করেন। তবে শেষ পর্যন্ত ব্যাংকঋণের কথা তিনি স্বীকার করে বলেন, যখন তাঁর নামে এই ঋণ নেওয়া হয়, তখন সেটা তিনি জানতেন না। কীভাবে টাকা পরিশোধ করবেন জানতে চাইলে বলেন, তিনি জানেন না।
গ্রামের স্থানীয় লোকজন জানান, হাজীর পাড়া গ্রামের সুলতান আহমদের ছেলে মুশতাক মিঞা। এক চাচা তাঁকে লালন-পালন করেছেন। ইসলামী ব্যাংকের ডিএমডি আকিজ উদ্দিনের গ্রামের বাড়িতে রান্নার কাজ করেন মুশতাক মিঞা। পাশাপাশি আকিজ উদ্দিনের বাসার দেখভালও করেন। সবজরপাড়ায় আকিজ উদ্দিনের বাড়ি থেকে মুশতাক মিঞার বাড়ির দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার। এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমেরও আদি নিবাস চট্টগ্রামের পটিয়ায়।
স্থানীয় লোকজন জানান, ওই গ্রামের অনেকের জাতীয় পরিচয়পত্র ও ছবি ব্যবহার করে ব্যাংকঋণ নেওয়া হয়েছে, যার বিনিময়ে তাঁরা প্রতি মাসে ভাতা পান।
মোহাম্মদ মুশতাক মিঞার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চাল-ডালের ব্যবসা করতে ব্যাংকে হিসাব খোলা হয়েছিল। তবে ব্যবসা করা হয়নি। সরকার পরিবর্তনের পর আকিজ সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
ব্যাংকের নথিতে মোস্তাক ট্রেডার্সের ঠিকানা পুরান ঢাকার বংশালের আগা সাদেক সড়কের ৯৬ নম্বর বাড়ি। সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, ওই ভবনের নিচতলায় মা ট্রেডার্স, মদিনা ট্রেডার্স, আলিক ডিপার্টমেন্টাল স্টোরসহ কয়েকটি দোকান রয়েছে। তবে মোস্তাক ট্রেডার্স নামে কোনো প্রতিষ্ঠান গত ২৫ বছরে সেখানে ছিল না বলে জানান এসব দোকানের মালিকেরা।
গত ২৮ আগস্ট ‘এস আলমের পিএসের প্রতিষ্ঠানের হিসাবেই শতকোটি টাকা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, আকিজ উদ্দিন-সংশ্লিষ্ট মোস্তাক ট্রেডার্সের ১৫ কোটি ৪ লাখ টাকা অবরুদ্ধ করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। এরপর মোস্তাক ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ মুশতাক মিঞা পরিচয়ে ডাকযোগে প্রথম আলোর কাছে পাঠানো এক প্রতিবাদপত্রে বলা হয়, এস আলম গ্রুপ বা আকিজ উদ্দিনের সঙ্গে মোস্তাক ট্রেডার্সের কোনো সম্পর্ক নেই। ওই প্রতিবাদপত্রে কোনো ফোন নম্বর দেওয়া হয়নি, তবে প্রতিবাদপত্রে বংশালের ১৬ নম্বর আগা সাদেক রোডের ঠিকানা দেওয়া হয়। তবে চিঠির ওপর নাম লেখা ছিল মোস্তাক মিয়া, ঠিকানা চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের চৌমুহনির চারিড়াপাড়া।
ওই প্রতিবাদপত্রের সূত্র ধরে বংশালের আগা সাদেক রোডের ১৬ নম্বরে গিয়ে দেখা যায়, একজন মানুষ চলতে পারে এমন সরু গলি পেরিয়ে সেটি জীর্ণ একটি বাড়ির ঠিকানা। তবে সেখানেও মোস্তাক ট্রেডার্স নামে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই।
ইউনিয়ন ব্যাংকের বনানী শাখায় হিসাব খোলার দিনই ১৭টি লেনদেনের মাধ্যমে নগদ ২৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকা জমা করা হয়। এর পরের দিন ১৬ নভেম্বর সাতবারে জমা দেওয়া হয় নগদ ১০ কোটি টাকা। ২০২২ সালের ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে হিসাবটিতে টাকা জমা করা হয়। ওই বছরের ১৭ নভেম্বর একসঙ্গে দুটি চেক বই নেওয়ার জন্য চাহিদাপত্র দেন গ্রাহক। এরপর ওই হিসাবে এক বছর কোনো লেনদেন হয়নি।
এই হিসাব থেকে নগদ টাকা উত্তোলন শুরু হয় ২০২৩ সালের ১০ ডিসেম্বর, জাতীয় নির্বাচনের আগে আগে। ওই দিন বনানী শাখা থেকে এক চেকে উত্তোলন করা হয় ২ কোটি ৫১ লাখ টাকা ও ১৪ ডিসেম্বর গুলশান শাখা থেকে তোলা হয় ১ কোটি টাকা। এরপর সব টাকা তোলা হয় গুলশান শাখা থেকে। ২৮ ডিসেম্বর তোলা হয় ৪১ কোটি টাকা। এর মধ্যে পৃথক পৃথক চেকে ১০ কোটি, ৬ কোটি ও পাঁচটি চেকে ৫ কোটি টাকা করে মোট ২৫ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়। চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি তোলা হয় ১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। ৭ জানুয়ারি ছিল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এরপর ৯ জানুয়ারি পাঁচটি চেকের মাধ্যমে হিসাব থেকে ২৫ কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়।
ওই দিনের পর হিসাবটিতে লেনদেন বন্ধ ছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ১৫ আগস্ট পে-অর্ডারের মাধ্যমে হিসাবে থাকা ৪ লাখ ৩২ হাজার টাকা তুলে নেওয়া হয়। এরপর ২০ আগস্ট হিসাবটি পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এই হিসাব খোলার সঙ্গে যুক্ত একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, হিসাবধারীর পরিচয় যাচাই না করে সেই সময় এস আলমের ব্যক্তিগত সচিব আকিজ উদ্দিন ও ব্যাংকের সাবেক এমডি এ বি এম মোকাম্মেল হক চৌধুরীর নির্দেশে হিসাবটি খোলা হয়েছিল। এই হিসাবই পরে নির্বাচনের সময় অর্থ লেনদেনের কাজে ব্যবহার করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট বিএফআইইউর নিয়ম অনুযায়ী, কোনো ব্যাংক হিসাবে ১০ লাখ টাকার বেশি নগদ জমা ও উত্তোলন হলে ব্যাংকগুলোকে নগদ লেনদেন প্রতিবেদন (সিটিআর) ও যেকোনো হিসাবে হঠাৎ অস্বাভাবিক লেনদেন হলে সন্দেহজনক লেনদেন (এসটিআর) প্রতিবেদন জমা দিতে হয়। তবে ইউনিয়ন ব্যাংক মোস্তাক ট্রেডার্সের হিসাবের ক্ষেত্রে ওই নিয়ম পরিপালন করেনি বলে জানা গেছে।
ইউনিয়ন ব্যাংকেরই দিলকুশা শাখা থেকে মোস্তাক ট্রেডার্সের নামে ২০২২ সালের ডিসেম্বর ও গত বছরের মার্চে মোট ৫৫ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছিল, যার পুরোটাই এখন খেলাপি হয়ে পড়েছে।