ঋণের অপব্যবহার হলেই ইচ্ছাকৃত খেলাপি

ব্যাংকের পরিচালক আর্থিক, বিমা ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানের পরিচালক থাকতে পারবেন না। ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিদেশ ভ্রমণ, লাইসেন্স ও কোম্পানি নিবন্ধনে নিষেধাজ্ঞা।

বাংলাদেশ ব্যাংক

কোনো ব্যাংকের পরিচালক থাকাকালে কেউ একই সঙ্গে আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিমা কোম্পানি বা সহযোগী কোনো প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পদে থাকতে পারবেন না। কোনো ব্যাংকে একক কোনো পরিবারের ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার থাকবে না। আর ৫ শতাংশের বেশি শেয়ার কিনতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হবে।

পাশাপাশি ব্যাংকের পরিচালক ও তাঁদের সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানের ঋণ বা সুদ মওকুফ করতে পারবে না ব্যাংক। কোনো পরিচালক ঋণের অপব্যবহার করলে সেটাকে  ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।

এমন কয়েকটি ধারা যুক্ত করে গত ২৬ জুন জাতীয় সংসদে ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধনী পাস হয়, যা কার্যকর হলে ব্যাংক খাত অনিয়ম ও দুর্নীতিমুক্ত হতে সহায়ক হবে বলে মনে করেন খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এদিকে সংশোধনীতে ব্যাংক পরিচালকদের মেয়াদ ৯ বছর থেকে বাড়িয়ে ১২ বছর করার পাশাপাশি খেলাপিদের ঋণ নেওয়ার সুযোগও দেওয়া হয়েছে, যা পুরো সংশোধনীকে বিতর্কের মুখে ফেলেছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংক পরিচালকেরা অন্য কোথাও পরিচালক থাকবেন না, এটা ভালো উদ্যোগ। এতে তাঁদের প্রভাব কমবে। আইনে অনেক ভালো কিছু আছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও অনেক ক্ষমতা দেওয়া আছে। তবে এসবের প্রয়োগ হয় না। সে জন্য ব্যাংক খাতে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে।

সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, পরিচালকদের মেয়াদ বাড়ানোয় ও খেলাপিদের ঋণ নেওয়ার সুযোগ দেওয়ায় খাতটি আরও দুর্বল হয়ে পড়বে।

কারা পরিবার ও পরিবারের সদস্য বিবেচিত হবেন, তা আইনের সংশোধনীতে স্পষ্ট করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কোনো ব্যক্তির স্ত্রী, স্বামী, পিতা, মাতা, পুত্র, কন্যা, ভাই, বোন ও ওই ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল কোনো ব্যক্তি।

এদিকে ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার না থাকার নিয়ম কার্যকর হলে বেসরকারি খাতের বেশ কয়েকটি ব্যাংকের মালিকদের শেয়ার ছাড়তে হবে। আইনে এ নিয়ে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি বা একই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ব্যাংকের শেয়ার কেন্দ্রীভূত করা যাবে না। কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি বা কোনো পরিবারের সদস্যরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, একক বা অন্যের সঙ্গে যৌথভাবে বা উভয়ভাবে কোনো ব্যাংকের শতকরা ১০ ভাগের বেশি শেয়ার কিনতে পারবেন না।

অন্য কোম্পানির পরিচালক পদে না থাকা নিয়ে আইনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি কোনো ব্যাংকের পরিচালক হলে একই সময়ে তিনি অন্য কোনো ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিমা কোম্পানি বা এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো সহযোগী প্রতিষ্ঠানে বা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিবেচনায় এরূপ কোনো প্রতিষ্ঠান, যা ওই ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা বিমা কোম্পানির ওপর নিয়ন্ত্রণ, যৌথ নিয়ন্ত্রণ বা উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করে, এমন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পদে থাকবেন না।

সুদ মওকুফ না করা নিয়ে আইনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্ব অনুমোদন ছাড়া কোনো ব্যাংক তার কোনো পরিচালক, তার পরিবারের সদস্য এবং এমন কোনো প্রতিষ্ঠান, যেখানে ব্যাংক পরিচালক বা পরিচালকের পরিবারের সদস্যের শেয়ার রয়েছে, তার সুদ মওকুফ করতে পারবে না। পাশাপাশি কোনো প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ধারক পরিচালক, জামিনদার, ম্যানেজিং এজেন্ট, মালিক বা অংশীদার বা পরিচালক ও পরিচালকের পরিবারের স্বার্থ রয়েছে, এমন প্রতিষ্ঠানেরও সুদ মওকুফ করতে পারবে না। ২০২২ সালে দেশের বেসরকারি খাতের ব্যাংকের পরিচালকেরা একে অপরের ব্যাংকের প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার সুদ মওকুফ করে নেয়।

এদিকে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি কারা হবেন, তা-ও আইনে সুস্পষ্ট করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঋণ বা সুদ পরিশোধ না করা, জালিয়াতি, প্রতারণা বা মিথ্যা তথ্য প্রদানের মাধ্যমে ঋণ নেওয়া, যে উদ্দেশ্যে ঋণ নেওয়া হয়েছে, সেই উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ওই ঋণ ব্যবহার করা। এ ছাড়া ঋণের বিপরীতে প্রদত্ত জামানত লিখিত অনুমোদন ছাড়া হস্তান্তর বা স্থানান্তর করলে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে বিবেচনা করা হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সময়-সময় ইচ্ছাকৃত খেলাপির সংজ্ঞা ঠিক করতে পারবে। পাশাপাশি ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিদেশে ভ্রমণ, বাণিজ্যিক লাইসেন্স ও কোম্পানি নিবন্ধনে নিষেধাজ্ঞা দিতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান চিঠি পাঠালে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।