গতকাল ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণার পর গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। সেই প্রশ্নোত্তর পর্বের চুম্বক অংশ এখানে ছাপা হলো।
এই মুদ্রানীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য কী কী। এটা কীভাবে আলাদা?
আব্দুর রউফ তালুকদার: আমরা আগে যে মুদ্রানীতিগুলো ঘোষণা করেছিলাম, সেগুলো ছিল বাজারে মুদ্রার সরবরাহ কেমন হবে, তার ওপর নির্ভর করে। এবার সারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কী করা যেতে পারে, তা বিবেচনায় নিয়ে মুদ্রানীতি করা হয়েছে। এটি একটি মৌলিক পরিবর্তন। এ জন্য সুদহারের সীমা তুলে নেওয়া হয়েছে। আমাদের গ্রস ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভ (জিআইআর) হিসাব করার জন্য আইএমএফ যেভাবে বলেছে, সেভাবে হবে। আবার আমরা আগে যেভাবে করতাম, সেটাও চলবে। নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে, যাতে ব্যাংকের হাতে টাকা কম যায়।
মুদ্রানীতি আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়ন কি না?
আব্দুর রউফ তালুকদার: আইএমএফ নিয়ে দেশের অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, তারা দুর্বল শর্তে ঋণ দিয়েছে। এতে যাঁরা আইএমএফে চাকরি করেছেন, তাঁরা আরও বেশি কষ্ট পেয়েছেন। আইএমএফের পরামর্শ যখন প্রয়োজন হয়, তখন শোনা হয়। প্রয়োজন মনে না করলে আমরা শুনি না। তাদের দেওয়া ঋণ সবচেয়ে সস্তা। সুতরাং, তাদের থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে। এখন তারা কিছু শর্ত দেবেই। তাদের শর্ত পালনের চেষ্টা আছে। এটা করলে যদি আমাদের অর্থনীতির জন্য সুবিধা হয়, তাহলে সেটা করতে তো কোনো সমস্যা নেই। তবে আমরা আইএমএফের মতো করে চলছি, সেটা বলা যাবে না। কারণ, আমাদের নিজেদেরও চিন্তাভাবনা আছে। সেগুলোও সামনে নিয়ে এগোতে হচ্ছে।
আগের মুদ্রানীতি ব্যর্থ হয়েছে কি না?
আব্দুর রউফ তালুকদার: এমন প্রশ্ন হতেই পারে। তবে আমরা দেখছি সারা পৃথিবীতে এখন এই ধরনের নীতি নেওয়া হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা আছে। কেউ পারছে, আবার কেউ পারছে না। ইউরোপের অনেক দেশে এমন নীতি নেওয়ার পরেও মূল্যস্ফীতি এখনো নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। তাদের মূল্যস্ফীতি আমাদের চেয়েও অনেক বেশি। এখন আপনি এটাও প্রশ্ন করতে পারেন ইউরোপের মুদ্রানীতি ব্যর্থ হয়েছে কি না। আমরা একটা নীতি দিয়ে চেষ্টা করি, সেটা কার্যকর না হলে অন্য একটা নীতি নিই। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। এখানে ব্যর্থ হওয়ার কোনো বিষয় আছে বলে আমি মনে করি না।
তবে গত মাসেও মূল্যস্ফীতি প্রায় দশের কাছাকাছি দেখা গেছে। সেই থেকে বলা যেতে পারে, আমাদের আগের যে মুদ্রানীতি ছিল, সেটা হয়তো ততটা কাজ করেনি। এ জন্য আমরা মুদ্রানীতিতে এতটা পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছি। আগের থেকে পুরো মুদ্রানীতির কাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছে। আমার মনে হয়ে যে এই অবস্থা চলমান থাকবে।
সংকোচনমূলক নীতি নেওয়া হলে বিনিয়োগ কীভাবে বাড়বে?
আব্দুর রউফ তালুকদার: আমরা সংকোচনমূলক নীতি নিয়েছি ঠিক, তবে আমরা যদি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, তাহলে উৎপাদন–সম্পর্কিত অর্থায়ন চলমান থাকবে। এসএমই বা কৃষির মতো খাত যেন টাকা পায়, সেটা আমরা নিশ্চিত করব। নতুন নীতিতে আমদানি কমানোর চিন্তা থাকবে। রপ্তানি বাড়ানোর চেষ্টা থাকবে। আমরা বলে দেওয়ার পরও বিলাসদ্রব্যের পণ্যের আমদানি সেভাবে কমানো যায়নি। দামি গাড়ি আসা থামেনি। অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসবহুল আমদানি যেন কমে, সেই ব্যবস্থা আমরা করছি।
বেসরকারি খাতের ঋণে প্রবাহ কমিয়ে, সরকারকে ঋণ দিয়ে প্রবৃদ্ধি কীভাবে হবে?
আব্দুর রউফ তালুকদার: সরকার ঋণ নিয়ে সরকারি কর্মচারীদের বেতন দেয় না বা ঋণ শোধ করে না। কিংবা ভর্তুকিও দেয় না। এই ঋণের পুরোটা দিয়ে সরকার এডিপি বাস্তবায়ন করে। যেমন সরকার একটি বিদ্যুতের লাইন তৈরি করলে, সেটা সরকারের একটা বিনিয়োগ। এই ধরনের বিনিয়োগ না হলে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগও কমে যায়।
অর্থনীতি কি সংকটে?
আব্দুর রউফ তালুকদার: অর্থনীতি পেছনের দিকে গেলে বলা যেত দুর্বল। তবে সেটা বলা যাবে না। আমরা মাত্র দুটো জায়গায় লড়ছি। এক. ডলারের বিনিময় হার, দুই. রিজার্ভ নিয়ে। এই দুটো জায়গায় কীভাবে ভালো করা যায়, সেটা নিয়ে মুদ্রানীতিতে চেষ্টা করার কথা বলা হয়েছে। আর হুন্ডির মহামারি চলছে। কিন্তু এর মধ্যেও গত বছরের তুলনায় প্রবাসী আয় এখনো বেশি এসেছে। সুতরাং, অর্থনীতিকে দুর্বল বলা যাবে না। বরং এটা সবল হচ্ছে।
সরকারকে ঋণ দিতে টাকা ছাপাতে হচ্ছে কি না?
আব্দুর রউফ তালুকদার: টাকা ছাপানো একটা চলমান প্রক্রিয়া। যত বড় অর্থনীতি, তত বেশি টাকা প্রয়োজন হয়। বিশ্বের সবখানে কিন্তু টাকা ছাপানো হয়। এটা খারাপ কিছু না। তবে দেখতে হবে সেই টাকা কোথায় যাচ্ছে। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারকে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। এটা করা হচ্ছে বাজারে তারল্যের সংকট আছে এ জন্য। আগের বছর তারল্যসংকট ছিল না। তখন আমরা সরকারের বন্ড কিনিনি। সরকার তখন ব্যাংকের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে। কিন্তু এখন সরকার যদি ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়, সে ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবাহ কমবে।
এদিকে মানুষ হাতে টাকা আটকে রাখছে। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকও গত বছরের জুলাই থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো ব্যাংক থেকে উঠিয়ে নিয়েছে। ডলার বিক্রির এই টাকা মুদ্রাবাজারের প্রায় ৬ শতাংশের মতো। এর মধ্যে সরকার নিয়েছে ৭০ থেকে ৭৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ, যে টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে এসেছিল, তার একটা অংশ বাজারে গেছে। তবে সেটা উঠিয়ে নিয়ে আসা টাকার চেয়ে কম। সরকার টাকা নিয়ে যদি তার ঋণ পরিশোধ করে, তাহলে সেটা মূল্যস্ফীতি বাড়াতে সাহায্য করে। কিন্তু সরকার যদি এই টাকা দিয়ে প্রয়োজনীয় কোনো পণ্য বা সেবা কেনে, তখন মূল্যস্ফীতিতে এর প্রভাব তেমন পড়ে না।
আব্দুর রউফ তালুকদার: এর আগে মুডি’স ২০১২ সালের দিকে রেটিং দিয়েছিল। তখন আমাদের অর্থনীতি যেমন ছিল, তার চেয়ে এখন অনেক ভালো। ইতিমধ্যে আমাদের ডলারের রিজার্ভ বা মজুত ৪৮ বিলিয়নেও উঠেছে। মাথাপিছু আয়ও গত কয়েক বছরে বেড়েছে। কিন্তু গত ১৩ বছরে তারা আমাদের রেটিং বাড়ায়নি।
আমি মনে করি, রেটিং কমিয়ে দেওয়ার পেছনে ভূরাজনৈতিক কারণ আছে। যেটা করা হয়েছে, সেটাকে পুরোপুরি অর্থনৈতিক ব্যাপার বলা যাবে না। আমাদের রেটিং কমানোর মতো কিছু হয়নি। যেসব সার্বভৌম বন্ডের কারণে আমাদের রেটিং কমানো হয়েছে, তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্যের বিষয়ে আরও ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য বলা হলেও তিনি ‘এই ব্যাপারে আর বিস্তারিত না বলাই ভালো’ বলে মন্তব্য করেন।
দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংকে সর্বকনিষ্ঠ চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, অভূতপূর্ব এই ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বক্তব্য কী?
আব্দুর রউফ তালুকদার: ইসলামী ব্যাংকে একজন চেয়ারম্যান আসছেন, যিনি বয়সে তরুণ। তিনি কিন্তু এর আগে আরেকটা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। আর বাংলাদেশ ব্যাংক কিন্তু কোনো ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিয়োগের ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা দিতে পারে না। ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগ কীভাবে হবে, সেটার নীতিমালা আছে। সেভাবে ব্যাংকের পরিচালক ঠিক করে দেওয়া হয়। আর পরিচালকেরা পরবর্তী সময়ে চেয়ারম্যান ঠিক করে থাকেন।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে ব্যাংকের পরিচালকেরা বলেছেন, তাঁরা আজীবন ব্যাংকের পর্ষদে থাকতে চান, এটা কীভাবে দেখেন?
আব্দুর রউফ তালুকদার: এটা ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুসারে হয়ে থাকে। আইনের যদি কোনো পরিবর্তন হয়, তাহলে সেটা হবে। আইন করে থাকে জাতীয় সংসদ। আমরা সেই আইনের বাস্তবায়ন করে থাকি।
ইসলামি ধারার কয়েকটিসহ আটটি ব্যাংক ছয় মাস ধরে নগদ জমা (সিআরআর) রাখতে পারছে না। এ জন্য তাদের ৬০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকা জরিমানা হয়েছে। তারা তা–ও দিতে পারছে না। এসব ব্যাংক নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভাবনা কী?
আব্দুর রউফ তালুকদার: ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা জরিমানা দিয়েছে। তাদের সঙ্গে বসা হয়েছে, বিভিন্ন নীতি–সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তারা যেন আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে সিআরআর রাখতে পারে, সে জন্য সময় দেওয়া হয়েছে। জরিমানা করে টাকা আদায় করা বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্দেশ্য নয়। পাশাপাশি বেসিক, আইসিবি ইসলামিক, পদ্মা ব্যাংকেও একই সমস্যা রয়েছে। বাকি ব্যাংকগুলো ইসলামি ধারার, যারা তারল্যসংকটে ভুগছে। আমাদের উদ্দেশ্য তাদের জরিমানা করা নয়। তাদের ব্যাংকিং ব্যবসায় ফিরিয়ে আনাই আমাদের উদ্দেশ্য।
অন্য ব্যাংকগুলোর নাম বলার জন্য গভর্নরকে অনুরোধ করা হলেও তিনি বলেননি।
আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব ডেবিট কার্ড আসছে। এটার নাম হবে টাকা পে কার্ড। এটাকে আমরা রুপির সঙ্গে যুক্ত করে ফেলব। সেই কাজটা করার প্রক্রিয়া চলমান আছে। এই কার্ড থাকলে বাংলাদেশে এটার মাধ্যমে লেনদেন করা যাবে। আবার কেউ ভারতে গেলে সেখানেও ১২ হাজার ডলারের যে ভ্রমণ কোটা আছে, সেই পরিমাণ টাকা সমমূল্যের রুপির কেনাকাটা করতে পারবেন। এর ফলে মুদ্রা বিনিময় হারের ফলে যে ক্ষতিটা হতো, সেটা আর হবে না। তাতে ৬ শতাংশের মতো অপচয় কমবে। বাংলাদেশের ভ্রমণকারীরা সবচেয়ে বেশি যান ভারতে। আমাদের অনেক ডলার বাঁচবে। বাংলাদেশ-ভারত আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক লেনদেন ২৭ বিলিয়ন ডলার। তাই ডেবিট কার্ড প্রচলনের ফলে ডলারের ওপর চাপ কমবে।