নারী কর্মীদের ঘরে-বাইরে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হয়; যা তাঁদের কর্মস্থলে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কাজ করে।
দেশের ব্যাংক খাতের ৬৬ শতাংশ বা দুই-তৃতীয়াংশ নারী কর্মী মনে করেন যে তাঁরা কর্মক্ষেত্রে সঠিক মূল্যায়ন পান না। নারী ব্যাংকাররা জানান, কাজের দক্ষতা অর্জনে তাঁদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে; আবার প্রায়ই আরোপিত কাজের বিষয়ে তাঁদের সঠিকভাবে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয় না। এ ছাড়া তাঁদের ঘরে-বাইরে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হয়; যা তাঁদের কর্মস্থলে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কাজ করে।
বিশ্বব্যাংকের বেসরকারি খাতবিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) এক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ‘দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান দেশগুলোতে ব্যাংকিং খাতে নারীদের অগ্রগতি’ শীর্ষক এই জরিপের ফল সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়।
আইএফসি ২০২২ ও ২০২৩ সালে বাংলাদেশ, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা—এই তিন দেশের ২০টি বেসরকারি ব্যাংকের নারী কর্মীদের ওপর জরিপটি পরিচালনা করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সাতটি বেসরকারি ব্যাংকের ১ হাজার ২৮৩ জন কর্মীর কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে নারী ৪৩৬ জন ও পুরুষ ৮৪৭ জন। ব্যাংক সাতটি হচ্ছে ব্র্যাক, ইস্টার্ণ, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, সিটি, প্রাইম ও বহুজাতিক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড।
লিঙ্গসমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হলে ব্যাংক খাতে নারী কর্মী বাড়ানো প্রয়োজন। বিশেষ করে নারী ব্যাংকারদের ধরে রাখতে এবং পেশাগত উন্নতির জন্য তাঁদের দক্ষতা বৃদ্ধির ওপরে জোর দিতে হবে, যেখানে এখন বড় দুর্বলতা রয়েছে।ফাহমিদা খাতুন, নির্বাহী পরিচালক, সিপিডি
আইএফসির জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে নীতিনির্ধারকেরা বিগত বছরগুলোয় বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। এসব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এই খাতে নারীর প্রতিনিধিত্বে তেমন সুখকর অবস্থা নেই। মোট কর্মীর তুলনায় নারী কর্মীর হার খুবই কম। উচ্চ পদগুলোতেও তাঁদের উপস্থিতি নগণ্য। এমনকি প্রতিবেশী নেপাল ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশের চেয়েও পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।
বিশ্বজুড়ে আর্থিক খাতে নারী কর্মীর গড় হার ৪৩ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশে এই হার অনেক কম। আইএফসির হিসাব অনুযায়ী, এ দেশের আর্থিক পরিষেবা খাতে মোট কর্মীর মাত্র ১৮ শতাংশ নারী, যা প্রতিবেশী ভুটান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় ৪০ শতাংশের ওপরে। ভারতে অবশ্য তা ১৮ শতাংশ।
আর্থিক খাতে নারী কর্মীর সংখ্যা যে সুখকর নয়, তা বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যেও দেখা যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে দেখা যায়, তিন বছর ধরে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে নারী কর্মীর সংখ্যা ১৬ শতাংশে আটকে আছে। ২০২৩ সালের শেষে এই খাতে নারী কর্মীর সংখ্যা ছিল ৩৩ হাজার ৩৪৬ জন। এর বিপরীতে পুরুষ কর্মীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৭০ হাজার ৩৫০।
ব্যাংকে চাকরির শুরুর স্তরেই (এন্ট্রি লেভেল) কমসংখ্যক নারী কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া নানা সমস্যায় মাঝপথে অনেকে চাকরি ছেড়ে দেন। এসব কারণে দেশের ব্যাংকগুলোতে নারী কর্মীর হার সেভাবে বাড়ছে না। আইএফসির তথ্যে দেখা যায়, এ দেশের ব্যাংকগুলোতে চাকরির শুরুর স্তরে নারী কর্মীর হার মাত্র ১৯ শতাংশ। এটাকে বৈষম্যমূলক নিয়োগ পদ্ধতি বলে উল্লেখ করে আইএফসি বলেছে, শুরুর স্তরেই এত কম পরিমাণে নিয়োগ পাওয়ায় ব্যাংক খাতে নারীদের সম্ভাবনা বিকাশের সুযোগ সীমিত রয়ে যায়।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, লিঙ্গসমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হলে ব্যাংক খাতে নারী কর্মী বাড়ানো প্রয়োজন। বিশেষ করে নারী ব্যাংকারদের ধরে রাখতে এবং পেশাগত উন্নতির জন্য তাঁদের দক্ষতা বৃদ্ধির ওপরে জোর দিতে হবে, যেখানে এখন বড় দুর্বলতা রয়েছে। এ ছাড়া বদলি ও পদায়নের ক্ষেত্রগুলোতেও নারীদের সামাজিক–পারিবারিক বাস্তবতা বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন।
দেশে ব্যাংক খাতের ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনাসহ সব পর্যায়েই নারী কর্মীর হার অনেক কম। জরিপে উঠে এসেছে যে বাংলাদেশে ব্যাংক খাতে কর্মরত নারীদের মধ্যে ৮৯ শতাংশই ঊর্ধ্বতন পদে যেতে চান। অথচ সে পর্যায়ে বর্তমানে এই হার মাত্র ১২ শতাংশ। আর মধ্যস্তরের ব্যাংক কর্মীদের মধ্যে ১৪ শতাংশ নারী।
অন্যদিকে, ব্যাংকগুলোর বোর্ড তথা পরিচালনা পর্ষদেও নারীর উপস্থিতি কম; যা আইএফসির হিসাবে ১৪ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের শেষে ব্যাংকের বোর্ড বা পর্ষদে নারীর অংশগ্রহণ কমে ১৩ দশমিক ৫১ শতাংশে নেমেছে। অথচ ২০২২ সালে এই হার ছিল ১৪ দশমিক ২২ শতাংশ। এ ক্ষেত্রেও নেপাল ও শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে।
আইএফসির জরিপমতে, কর্মস্থলে নারী ব্যাংকারদের অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে অনেক বাধা রয়েছে। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে বৈষম্যমূলক নিয়োগ। বিশেষ করে চাকরির শুরুর স্তরে নারী কর্মীর হার বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। বর্তমানে নারী ব্যাংকারদের জন্য দক্ষতা অর্জনে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণসহ অন্য সুযোগগুলো পর্যাপ্ত নয়, এটাকে দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করেছে আইএফসি।
সামাজিক-সাংস্কৃতিক সীমাবদ্ধতাকেও বড় সমস্যা হিসেবে দেখা হচ্ছে। সাধারণত নারীদের ওপর পরিবারের যত্ন নেওয়ার একটা বাড়তি চাপ বা প্রত্যাশা থাকে। ফলে চাকরির পাশাপাশি তাঁদের পরিবারের কাজও সামলাতে হয়। প্রায় ২৮ শতাংশ নারী কর্মী জানিয়েছেন, পরিবারে কাজের চাপ তাঁদের ক্যারিয়ারে বড় প্রভাব ফেলছে।