ইসলামি শরিয়া ব্যাংকিংয়ের ব্যবসা নিচ্ছে প্রচলিত ধারার ব্যাংক

দেশের ইসলামি ধারার কয়েকটি ব্যাংক যখন সংকটে পড়েছে, ঠিক তখন শরিয়া ব্যাংকিং ব্যবসায় নজর বাড়িয়েছে প্রচলিত ধারার কয়েকটি ব্যাংক। এসব ব্যাংক শরিয়া ব্যাংকিং সেবায় নতুন নতুন পণ্য আনছে, সব শাখায় শরিয়া ব্যাংকিং সেবা দেওয়ার জন্য আলাদা ডেস্ক চালু করছে। আবার কোনো কোনো ব্যাংক শরিয়া ব্যাংকিং সেবাকে প্রাধান্য দিয়ে নিজেদের সাইনবোর্ডেও পরিবর্তন এনেছে।

জানা গেছে, শরিয়া ব্যাংকিং ব্যবসায় নজর বাড়িয়ে এসব ব্যাংক ভালো সাড়াও পাচ্ছে। আবার কেউ কেউ ইসলামি ব্যাংকিং সেবা ঘিরে নতুনভাবে পরিকল্পনা করছে। পূর্ণাঙ্গ শরিয়া ব্যাংকগুলো যখন আমানত হারিয়েছে, তখন এসব ব্যাংক ভালো আমানত পেয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন ও শরিয়া ব্যাংকিং সেবা দেওয়া ব্যাংকগুলোর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ঋণের অনিয়মসংক্রান্ত খবর আলোচনায় আসার পর এসব ব্যাংকের আমানত কমে গেছে। এ ধাক্কায় ইউনিয়ন, গ্লোবাল ইসলামীসহ আরও কয়েকটি শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকের আমানতও কমে যায়। ফলে এসব ব্যাংককে বিশেষ তারল্যসুবিধা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক, চালু করতে হয় বিশেষ সুবিধাও।

প্রচলিত ব্যাংকের ইসলামি সেবা

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর—এই তিন মাসে পূর্ণাঙ্গ শরিয়াভিত্তিক ১০ ব্যাংকের আমানত কমেছে ১১ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা। পূর্ণাঙ্গ শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকের মোট আমানত ২০২২ সালের ডিসেম্বরের শেষে হয় ৩ লাখ ৭৯ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা, যা গত বছরের সেপ্টেম্বরে ছিল ৩ লাখ ৯১ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা।

আমানত কমলেও বিনিয়োগ বেড়েছে এসব ব্যাংকের। গত সেপ্টেম্বর শেষে বিনিয়োগ ছিল ৩ লাখ ৬৪ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা, যা ডিসেম্বরে বেড়ে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইসলামি ব্যাংকিং-সংক্রান্ত অক্টোবর-ডিসেম্বর ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংকগুলোর যখন এই পরিস্থিতি, তখন ভালো করেছে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর শরিয়া ব্যাংকিং ব্যবসা। গত ডিসেম্বর প্রচলিত ব্যাংকের শরিয়া ব্যাংকিং সেবায় আমানতের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ২৯ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকা। ২০২১ সাল শেষে প্রচলিত ব্যাংকের ইসলামি সেবায় আমানত ছিল ২২ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা। ফলে এক বছরে এসব ব্যাংকের শরিয়া ব্যাংকিং ব্যবসায় আমানত বেড়েছে ৭ হাজার ২৭২ কোটি টাকা।

তবে অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর ইসলামি সেবায় আমানত বেড়েছে ৪৬১ কোটি টাকা। তবে এ সময়ে তাদের বিনিয়োগ কমে যায় ২৭৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রচলিত ব্যাংকের ইসলামি ব্যাংকিং সেবা ঝুঁকি নিয়ে বিনিয়োগে যায়নি, বরং তারা বিনিয়োগ কমিয়ে ফেলে। চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতেও এসব ব্যাংকের ইসলামি সেবায় আমানত ও বিনিয়োগের একই পরিস্থিতি ছিল বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা।

এই কর্মকর্তারা বলছেন, পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংকগুলো ঝুঁকি নিয়ে অর্থায়ন করে যে বিপদে পড়েছে, তা থেকে অন্যরা শিক্ষা নিয়েছে। এ জন্য প্রচলিত ব্যাংকের ইসলামি সেবা দিনে দিনে ভালো করছে।

ইসলামি সেবায় প্রচলিত ২৪ ব্যাংক

শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকের পাশাপাশি প্রচলিত ধারার ২৪টি ব্যাংক ইসলামি ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। এসব ব্যাংক গঠন করেছে পৃথক শরিয়া বোর্ড। পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংকিং মডেল ইনকাম শেয়ারিং রেশিও (আইএসআর) অনুসরণ করছে কেউ কেউ। অর্থাৎ নির্দিষ্ট পরিমাণ লাভের বিপরীতে মুনাফা দিচ্ছে।

বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এসব কারণে গ্রাহকদের আস্থা বেড়েছে ইসলামি ব্যাংকিং সেবা দেওয়া প্রচলিত ধারার ব্যাংকের ওপর। কারণ, পূর্ণাঙ্গ শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকও এ ধারা অনুসরণ করছে না। আবার পূর্ণাঙ্গ শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকের ঋণে নানা অনিয়ম ধরা পড়ছে।

এ জন্য গ্রাহক আকর্ষণ বাড়াতে সাইনবোর্ডেও পরিবর্তন এনেছে বেসরকারি খাতের সিটি, পূবালী, মিডল্যান্ড, এনআরবি কমার্শিয়ালসহ আরও কয়েকটি ব্যাংক। পৃথক নাম দিয়ে সেবা চালু করেছে ব্যাংকগুলো।

ইসলামি ব্যাংকিং সেবার পরিস্থিতি

ব্যাংক এশিয়া ২০০৮ সাল থেকে এ সেবা দিচ্ছে। তারা আমানত পেয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। ২০২১ সালে ডিসেম্বরে সিটি ইসলামিক সেবা চালু করে সিটি ব্যাংক। সব শাখায় মিলছে এ সুবিধা। ইতিমধ্যে আমানত পেয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। মুঠোফোনে আর্থিক সেবা বিকাশের মাধ্যমে ব্যাংকটিতে যে আমানত জমা হচ্ছে, তার পুরোটাই হচ্ছে ইসলামিক সেবায়। এ জন্য ব্যাংকে টাকা জমা করতে গ্রাহকদের কোথাও যেতে হচ্ছে না, ঘরে বসে ইসলামিক সেবায় আমানত জমা করতে পারছেন।

ওয়ান ব্যাংকের ইসলামিক সেবায় আমানত জমা হয়েছে ৩৭৫ কোটি টাকা। দুই বছর আগে এমটিবি ইয়াকিন নামের সেবা চালু করেছে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক। সব শাখায় মিলছে এ সেবা। ইতিমধ্যে এক হাজার কোটি টাকা আমানত জমা হয়েছে।

জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুই বছরে আমাদের ইসলামি ব্যাংকিং সেবা মুনাফা শুরু করেছে। একেবারে ইসলামি বিধান মেনে আমরা এ সেবা দিচ্ছি। আমানতে কত মুনাফা দেওয়া হবে, তা উল্লেখ করা হচ্ছে না। আয় সাপেক্ষে মুনাফা দেওয়া হচ্ছে।’
২০১৯ সালে ইসলামিক ব্যাংকিং সেবা চালু করে পূবালী ব্যাংক। ইতিমধ্যে তাদের কাছে প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা আমানত জমেছে। সেবা মিলছে সব শাখাতেই। পূবালী ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ইসলামি ব্যাংকিংয়ে ভালো সাড়া মিলছে। সীমার মধ্যে বিনিয়োগও করা হয়েছে। প্রতি মাসে ১০০ কোটি থেকে ১৫০ কোটি টাকা আমানত বাড়ছে।

তাইয়্যিবাহ নামের ইসলামি ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে ঢাকা ব্যাংক। ব্যাংকটির এমডি এমরানুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ইসলামি ব্যাংকিং সেবায় ভালো সাড়া পাচ্ছি। সব শাখা থেকে এ সেবা পাওয়া যাচ্ছে। এরই মধ্যে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা আমানত জমা হয়েছে, আর বিনিয়োগ হয়েছে এক হাজার কোটি টাকার বেশি।’

এনসিসি ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ বলেন, ‘আমরা কিছু শাখায় ইসলামি ব্যাংকিং সেবা দেওয়া শুরু করেছি। যোগ্য শরিয়া বোর্ড গঠন করা হয়েছে। এ সেবার কিছু পণ্য অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। ইতিমধ্যে ৭৫ কোটি আমানত জমা হয়েছে। শিগগিরই সব শাখায় পৃথক ডেস্ক চালু করা হবে।

‘সালাম’ নামে ইসলামি ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে নতুন প্রজন্মের মিডল্যান্ড ব্যাংক। এতে আমানত জমা হয়েছে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা। ব্যাংকটির রিটেইল ডিস্ট্রিবিউশন বিভাগের প্রধান রাশেদ আকতার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের সব শাখায় ইসলামি ব্যাংকিং সেবা দেওয়া হচ্ছে, গ্রাহকেরও ভালো সাড়া মিলছে। বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণের ফলে চলতি বছরেও ইসলামি ব্যাংকিং সেবার প্রবৃদ্ধি ভালো হবে বলে আশা করছি।’