ঋণখেলাপিকে আরও ঋণ দেওয়ার উদ্যোগ অগ্রণী ব্যাংকের

নতুন করে গ্লোবাল করপোরেশনসকে আরও ২০ কোটি টাকা ঋণসুবিধা দিতে ব্যাংকের ওপর চাপ তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে।

ঋণ খেলাপি

এক ঋণখেলাপির বেনামি কোম্পানিকে নতুন করে ঋণ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংক। ইতিমধ্যে বেনামি ওই কোম্পানিকে প্রায় ৩৭ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে অগ্রণী ব্যাংকের বনানী শাখা। এখন নতুন করে আরও ২০ কোটি টাকার ঋণ ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।

অগ্রণী ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ের হেমলেট টাওয়ারে অবস্থিত গ্লোবাল করপোরেশনস নামের একটি কোম্পানিকে নথিপত্র যাচাই–বাছাই ছাড়া ৩৬ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে অগ্রণী ব্যাংক বনানী শাখা। ওই ঋণের মূল সুবিধাভোগী ঋণখেলাপি সেলিম চৌধুরী। আর ঋণের মূল জিম্মাদার সেলিম চৌধুরীর স্ত্রী নাহিদা চৌধুরী। সেলিম চৌধুরী ও নাহিদা চৌধুরী দুজনই ঋণখেলাপি।

যদিও নথিপত্রে ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল করপোরেশনসের মালিক হিসেবে দেখানো হয়েছে মোস্তফা মাহমুদ হাসান নামের এক ব্যক্তিকে। তবে ব্যাংক–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই ঋণের প্রকৃত সুবিধাভোগী সেলিম চৌধুরী, যিনি বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ বা বিপিএলের দল ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরসের মালিক। সেলিম চৌধুরী ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে চার ব্যাংক ও এক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।

সেলিম চৌধুরী আমাদের পুরোনো খেলাপি গ্রাহক। তাঁর ঋণ পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অন্য কারও নামে ঋণ নেওয়ার উদ্যোগ নিলে তা বন্ধ করা হবে।
মুরশেদুল কবীর, এমডি, অগ্রণী ব্যাংক

অগ্রণী ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ৩৬ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পর এখন নতুন করে গ্লোবাল করপোরেশনসের বিপরীতে আরও ২০ কোটি টাকা ঋণ সুবিধা দিতে ব্যাংকের ওপর চাপ তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে।

এই অবস্থায় প্রতিষ্ঠানটিকে আরও ২০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে ব্যাংকটির বনানী শাখা, যা বর্তমানে পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। এই ঋণের জামিনদার সেলিম চৌধুরীর চাচাতো ভাই জিহান হোসেন চৌধুরী। এই ঋণের জন্য ৫০ কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়েছে এবি ব্যাংকের গুলশান শাখা।

এদিকে, সেলিম চৌধুরী ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের কাছে ১১১ কোটি টাকা পাবে অগ্রণী ব্যাংকের তেজগাঁও শিল্প এলাকা শাখা। এর বাইরে ওই শাখা থেকেই সেলিম চৌধুরী তাঁর নিজের জমি জামানত দিয়ে খালাতো ভাই মনজুর আলমের নামে ৯৪ কোটি টাকা ঋণ বের করে নিয়েছেন। সেই টাকাও এখনো ফেরত পায়নি অগ্রণী ব্যাংক।

এদিকে অগ্রণী ব্যাংকের বনানী শাখার ঋণগ্রহীতা গ্লোবাল করপোরেশনসের প্রকৃত সুবিধাভোগী নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, হেমলেট টাওয়ারের সপ্তম তলায় অবস্থিত গ্লোবাল করপোরেট বিডি লিমিটেডের কার্যালয়ে মাঝেমধ্যেই অফিস করেন সেলিম চৌধুরী।

প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে জানতে গতকাল সোমবার হেমলেট টাওয়ারে গেলে এ নিয়ে কেউ কথা বলতে চাননি। পরে কোম্পানিটির একজন কর্মকর্তার মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে আকবর হোসেন নামের একজন নিজেকে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক বলে পরিচয় দেন। আকবর হোসেন জানান, গ্লোবাল করপোরেশনসের হয়ে খুলনায় জমি কেনা ও উন্নয়নের কাজ করেন তিনি। প্রতিষ্ঠানটির অন্য কোনো বিষয়ে তাঁর কোনো ধারণা নেই।

নথিপত্রে গ্লোবাল করপোরেশনসের ব্যবসার ধরন চাল, মসলা, বেভারেজ ফ্লেভার ও পাথর আমদানি এবং সরবরাহকারী। তবে অগ্রণী ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, গ্লোবাল করপোরেশনসের প্রকৃত সুবিধাভোগী সেলিম চৌধুরী ও তাঁর পরিবার।

যেভাবে শুরু

অগ্রণী ব্যাংকের বনানী করপোরেট শাখায় ২০২১ সালের ২২ এপ্রিল একটি হিসাব খোলে গ্লোবাল করপোরেশনস। ওই বছরের ১৭ আগস্ট প্রতিষ্ঠানটিকে আড়াই কোটি টাকা ঋণ ও ঋণসুবিধা দেয় ব্যাংকটি। এরপর গত বছরের ৩১ জানুয়ারি তা বাড়িয়ে ৬ কোটি টাকা করার সিদ্ধান্ত দেয় ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। গত বছরের ২৪ আগস্ট সেই ঋণসুবিধা বাড়িয়ে ৪১ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। বর্তমানে এই শাখায় প্রতিষ্ঠানটির ঋণের পরিমাণ প্রায় ৩৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে কিছু ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে।

অগ্রণী ব্যাংক থেকে নেওয়া প্রায় ৩৭ কোটি টাকার ঋণের বিপরীতে জামানত দেওয়া হয় সেলিম চৌধুরীর স্ত্রী নাহিদা চৌধুরীর নামে থাকা ফ্ল্যাট। পরে অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় এক চিঠির মাধ্যমে শাখাটিকে জানায়, নাহিদা চৌধুরী নিজে কোনো ঋণের আবেদন করেননি।

এমনকি তৃতীয় পক্ষীয় জামানত রাখার জন্যও নাহিদা চৌধুরীকে কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি। তাই ভবিষ্যতে সম্পত্তি নিলামের প্রশ্ন এলে তাতে আইনগত সমস্যা দেখা দিতে পারে। তারপরও ঋণ অনুমোদন হয় এবং সেই ঋণের বড় অংশ অন্য ব্যাংকে স্থানান্তর করে তুলে নেওয়া হয়। ওই ঋণের অর্থ থেকে জনৈক সেলিম ওমরা খানের মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখার হিসাবে পাঠানো হয় ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।

আরও ঋণ চায়

চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি বিদ্যমান প্রায় ৩৭ কোটি টাকার ঋণসুবিধা বাড়িয়ে ৫৭ কোটি টাকা করার আবেদন করে গ্লোবাল করপোরেশনস। এ জন্য এবি ব্যাংকের ৫০ কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি এবং বনানীর হেমলেট টাওয়ারের সপ্তমতলার জায়গাও বন্ধক হিসেবে রাখা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে অগ্রণী ব্যাংকের বনানী শাখা, ব্যাংকটির ঋণ কমিটি, নিরীক্ষা বিভাগ কোনো আপত্তি না জানিয়ে ঋণটি অনুমোদনের প্রস্তাব করেছেন।

ব্যাংকটির দুজন কর্মকর্তা জানান, একটি পক্ষ চাপ দিয়ে এসব ঋণ অনুমোদন করিয়েছে। তাদের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ব্যাংকটির দুজন কর্মকর্তাকে শাখা থেকে বদলিও করা হয়।

জানতে চাইলে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুরশেদুল কবীর গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেলিম চৌধুরী আমাদের পুরোনো খেলাপি গ্রাহক। তাঁর ঋণ পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অন্য কারও নামে ঋণ নেওয়ার উদ্যোগ নিলে তা বন্ধ করা হবে।’

এ বিষয়ে জানতে সেলিম চৌধুরীর মুঠোফোনে যোগাযোগ করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।

অগ্রণী ব্যাংক পরিস্থিতি

রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের পরের অবস্থানে রয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। গত মে মাস পর্যন্ত ব্যাংকটির আমানত ছিল ৯৭ হাজার কোটি টাকা ও ঋণ ৭৩ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা। ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ গত মার্চ শেষে ছিল ১৫ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ২২ শতাংশ।

২০২১ সালে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল ৬৪৮ কোটি টাকা, যা গত বছর বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ২০২ কোটি টাকা। ব্যাংকটি গত ছয় বছরে আগ্রাসীভাবে শিল্পঋণে ঝুঁকেছে। ফলে শিল্পঋণের ক্ষেত্রে ৯৮টি সিন্ডিকেট ঋণে অংশগ্রহণ করেছে। গত এপ্রিল শেষে ব্যাংকের ঋণস্থিতির মধ্যে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা বা ৪৯ শতাংশই ছিল শিল্প খাতে।