অনিয়মের কারণে তারল্যসংকটে পড়া সাত ব্যাংককে বিরল সুবিধায় ২২ হাজার কোটি টাকা ধার দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব ব্যাংক যাতে বিদায়ী ২০২৩ সালের শেষ কার্যদিবসে তারল্যসংকটের প্রকৃত চিত্রের পরিবর্তে তুলনামূলক ভালো চিত্র দেখানোর সুযোগ পায়, সে জন্য তাদের এমন সুবিধা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ‘লেন্ডার অব দ্য লাস্ট রিসোর্ট’ হিসেবে এই ধার দিয়েছে।
এই বিশেষ ব্যবস্থায় টাকা ধার পাওয়া ব্যাংকগুলো হচ্ছে ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক। বাকি দুটি হলো প্রচলিত ধারার ন্যাশনাল ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক।
এর আগে ২০২২ সালেও আর্থিক হিসাব ভালো দেখাতে শরিয়াহভিত্তিক এই পাঁচ ব্যাংককে একই সুবিধায় ১৪ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা ধার দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তখন থেকেই ব্যাংক পাঁচটি তারল্যসংকটে ভুগছে। এই পাঁচ ব্যাংক চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন।
‘এসব ব্যাংককে এভাবে চলতে দেওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকাশ পাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে পুরো খাতে। এখনই পদক্ষেপ না নিলে আর্থিক খাতের ওপর মানুষের আস্থা আরও কমে যাবে।’সালেহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
এভাবে সুবিধা দেওয়ার ঘটনা বিরল। কারণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিতে হলে তাদের কাছে ব্যাংকগুলোকে বিল বা বন্ড জমা রাখতে হয়। তা না হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ধার দিতে পারে না। কিন্তু এসব ব্যাংকের কাছে টাকা ধার নেওয়ার জন্য ব্যবহারযোগ্য বিল-বন্ড নেই। সে জন্য তারা প্রতিশ্রুতিপত্র (ডিমান্ড প্রমিজরি নোট) প্রদান করে টাকা ধার নিয়েছে তারা। এই প্রতিশ্রুতিপত্রের মাধ্যমে যেকোনো উপায়ে টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ব্যাংকগুলো।
তবে এই ঘটনাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বিরল সুবিধা বলতে রাজি নন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অন্যান্য নানা ব্যবস্থার পাশাপাশি ডিমান্ড প্রমিজরি নোটের মাধ্যমে টাকা ধার দেওয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মিত কাজের অংশ। ডিমান্ড প্রমিজরি নোটের মাধ্যমে ১৮০ দিন মেয়াদ পর্যন্ত টাকা ধার দেওয়া যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার মেনে এই টাকা ধার দেওয়া হয়েছে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোকে তাদের কাছে থাকা গ্রাহকের মোট আমানতের বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নগদ ৪ শতাংশ টাকা সিআরআর (ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও) হিসেবে রাখতে হয়। এ ছাড়া আমানতের সাড়ে ৫ শতাংশ রাখতে হয় বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) হিসেবে।
অন্যদিকে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোকে মোট আমানতের বিপরীতে নগদে ৪ শতাংশ টাকা ও আমানতের সাড়ে ৫ শতাংশ পরিমাণ বিল ও বন্ড বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) হিসেবে রাখতে হয়। এ দুটি ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জরিমানার মুখে পড়তে হয় ব্যাংকগুলোকে। নগদ টাকা জমা থাকে চলতি হিসাবে। তবে এসব ব্যাংকের পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে প্রায় এক বছর ধরে চাহিদামতো টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রাখতে পারছে না।
জানা গেছে, শেষ মুহূর্তে এসে ব্যাংকগুলো বছরের আর্থিক হিসাবের ঘাটতির তথ্য গোপন করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়। কিন্তু টাকা ধার করার মতো কোনো বিল-বন্ড তাদের কাছে ছিল না। সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শেই ব্যাংকগুলো প্রতিশ্রুতিপত্র দিয়ে টাকা ধার চায়। তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনুমোদন করে। সুদ ধরা হয় ৯ দশমিক ৭ শতাংশ।
সাত ব্যাংককে গত ২৮ ডিসেম্বর সব মিলিয়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ধার দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মেয়াদ তিন দিন, যা আজ সোমবার ব্যাংকগুলোর ফেরত দেওয়ার কথা। সবচেয়ে বেশি টাকা পেয়েছে ইসলামি ব্যাংক।
এ নিয়ে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও কোনো কোনো ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফোন ধরেননি। আবার কোনো কোনো এমডি সাড়া দিলেও কথা বলতে চাননি।
সংকটে থাকা সাত ব্যাংকের মধ্যে পাঁচটি শরিয়াহ ব্যাংক। তাদের পরিস্থিতি একরকম, বাকি দুটোর অন্য রকম। শরিয়াহ ব্যাংকগুলোর পরিচালকদের নানা অনিয়মের কারণে এগুলোর আমানত কমেছিল। এরপর আবার তা বেড়ে যায়। ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চাহিদামতো টাকা জমা রাখতে পারছে না। আবার অনিয়মও থামেনি। উল্টো কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘বিশেষ হিসাব’ তৈরি করে এসব ব্যাংকের লেনদেনব্যবস্থা সচল রেখেছে। কারণ, এসব ব্যাংকের কোনো গ্রাহক যাতে চেক ক্লিয়ারিং, এটিএম অর্থ উত্তোলনসহ কোনো লেনদেনে ব্যর্থ না হন।
পদ্মা ও ন্যাশনাল ব্যাংকে আমানত আসা কমে গেছে। তবে শরিয়াহ ব্যাংকগুলোর মতো তাদের চলতি হিসাব ঘাটতিতে পড়েনি। বছরের শেষ কার্যদিবসে পদ্মা ব্যাংকের সিআরআর রাখতে প্রয়োজন ছিল ২৯১ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ব্যাংকটির হিসাবে ছিল মাত্র ৮৬ কোটি টাকা। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিশ্রুতিপত্রে স্বাক্ষর নিয়ে পদ্মা ব্যাংককে দেয় ২০৫ কোটি টাকা। একই রকম অবস্থায় থাকা ন্যাশনাল ব্যাংককেও একইভাবে ধরা দেওয়া হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, সরকার চেয়েছে বলেই ন্যাশনাল ব্যাংকে সংস্কারের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে শরিয়াহ ব্যাংকগুলোকে জামানত ছাড়া টাকা ধার দিতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব ব্যাংককে এভাবে চলতে দেওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকাশ পাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে পুরো খাতে। এখনই পদক্ষেপ না নিলে আর্থিক খাতের ওপর মানুষের আস্থা আরও কমে যাবে।’