বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংকগুলোর আমানত বেড়েছে ৪,৭৬১ কোটি টাকা। ঋণ বেড়েছে ৬,৪৫২ কোটি টাকা।
দেশের শরিয়াহভিত্তিক কিছু ব্যাংকে যে পরিমাণ আমানত জমা হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ বা বিনিয়োগ করা হচ্ছে। আবার এই ধারার কিছু ব্যাংক থেকে গ্রাহকেরা আমানত তুলে নিলেও এসব ব্যাংকের ঋণ বিতরণ বা বিনিয়োগ বাড়ছে। শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোতে গত ফেব্রুয়ারি মাসে সম্মিলিতভাবে আমানত বেড়েছে ৪ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। তবে একই মাসে ব্যাংকগুলো ৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা ঋণ বা বিনিয়োগ করেছে। ফলে এক মাসে আমানতের চেয়ে ১ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা বেশি বিনিয়োগ করেছে ব্যাংকগুলো।
শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর ঋণ, আমানতসহ আর্থিক বিভিন্ন পরিস্থিতি নিয়ে সর্বশেষ প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল বুধবার এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনের বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ফেব্রুয়ারিতে আমানতের চেয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধির গতি ছিল বেশি। বর্তমানে ইসলামি ধারার বেশির ভাগ ব্যাংকের চলতি হিসাব ঘাটতিতে পড়েছে।
দেশে বর্তমানে পূর্ণাঙ্গ শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক রয়েছে ১০টি। ব্যাংকগুলো হচ্ছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল), ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোতে আমানত ছিল ৩ লাখ ৮৪ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা, যা জানুয়ারির শেষে তা কমে ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৩০৪ কোটি টাকায় নেমে আসে। ফেব্রুয়ারিতে আমানত কিছুটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৮০ হাজার ৬৬ কোটি টাকায়। অর্থাৎ জানুয়ারির তুলনায় ফেব্রুয়ারিতে আমানত বেড়েছে ৪ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা।
বাংলাদেশে অনেক ব্যাংকই খারাপ হয়ে পড়ছে। ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলো এর মধ্যে বেশি দুর্বল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশেষ সহায়তা দিয়ে এসব ব্যাংককে চলতে দিচ্ছে।মোস্তফা কামাল মুজেরী, সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংক
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণ বা বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ৪৫ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা, যা জানুয়ারি মাসে বেড়ে দাঁড়ায় ৪ লাখ ৪৯ হাজার ৭৩ কোটি টাকায়। ফেব্রুয়ারি মাস শেষে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৫৫ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা। সেই হিসাবে, জানুয়ারির তুলনায় ফেব্রুয়ারিতে বিতরণ করা ঋণ বেড়েছে ৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা।
আমানতের চেয়ে ঋণের গতি বেশি কেন জানতে চাইলে ইসলামি ধারার একাধিক ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, তারল্যসংকটে পড়া একটি গ্রুপের পাঁচটি ব্যাংক আমানতের পাশাপাশি মূলধন, নিরাপত্তা সঞ্চিতি ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার নেওয়া অর্থও বিনিয়োগ করছে। পাশাপাশি অন্য ব্যাংক থেকে ধার করেও গ্রাহকদের ঋণ দিচ্ছে। পাশাপাশি এসব ব্যাংকের চলতি হিসাব বড় ধরনের ঘাটতিতে পড়েছে। এসব ব্যাংকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো নানাভাবে সহায়তা করছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে জানুয়ারিতে ১১ হাজার ৬২১ কোটি টাকার প্রবাসী আয় এলেও ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়ায় ৯ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকায়। পাশাপাশি আমদানি–রপ্তানির পরিমাণও কমে গেছে এসব ব্যাংকের মাধ্যমে। ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে জানুয়ারিতে আমদানি হয়েছিল ১০ হাজার ৯১০ কোটি টাকার পণ্য। ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়ায় ৮ হাজার ৬৮৬ কোটি টাকায়। এ ছাড়া ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে জানুয়ারিতে পণ্য রপ্তানি হয়েছিল ৬ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকার। ফেব্রুয়ারি মাসে তা কমে দাঁড়ায় ৬ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা।
ইসলামি ধারার কয়েকটি ব্যাংকে নানা অনিয়মের কারণে ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে গ্রাহকের আস্থায় কিছুটা ছেদ পড়ে। এ জন্য বার্ষিক আর্থিক অবস্থা ভালো দেখাতে ২০২২ ও ২০২৩ সালের শেষ কার্যদিবসে ইসলামি ধারার পাঁচ ব্যাংককে কোনো জামানত ছাড়াই বিশেষ ব্যবস্থায় টাকা ধার দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
আমানতের চেয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধির কারণ জানতে ইসলামি ধারার তিনটি ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা এসব বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কামাল মুজেরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশে অনেক ব্যাংকই খারাপ হয়ে পড়ছে। ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলো এর মধ্যে বেশি দুর্বল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশেষ সহায়তা দিয়ে এসব ব্যাংককে চলতে দিচ্ছে। এভাবে আর চলতে দেওয়া ঠিক হবে না। এভাবে চললে সমস্যা বড় আকার ধারণ করতে পারে, দেশের অর্থনীতি তা সামাল দিতে পারবে না। এ জন্য কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে না রেখে এখনই সমাধানে জোরেশোরে উদ্যোগ নিতে হবে।’