দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যত টাকা জমা আছে, তার অর্ধেকের বেশি কোটিপতিদের অর্থ। গত ডিসেম্বর শেষে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ৪৪ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা, যার মধ্যে ৫৫ শতাংশের বেশি বা ২৪ হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা কোটিপতিদের আমানত। এসব আমানতকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় এক কোটি থেকে শুরু করে দেড় শ কোটি টাকার বেশি আমানত রেখেছেন। আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ১০০ কোটি টাকার বেশি আমানত রেখেছেন। এ রকম আমানত হিসাব রয়েছে ছয়টি। এই ছয় হিসাবেই রয়েছে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শেষ আর্থিক অবস্থা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের করা এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সরকারি, বেসরকারি ও বিশেষায়িত মিলিয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৪০টি। এর মধ্যে সরকারি মালিকানাধীন ৩টি, বেসরকারি মালিকানাধীন ৩২টি ও বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ৫টি। এই ৪০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে গত ডিসেম্বর শেষে গ্রাহক বা আমানতকারীর হিসাব ছিল ৪ লাখ ৩১ হাজার ২২১টি। এসব হিসাবের মধ্যে কোটি টাকার বেশি আমানত জমা আছে, এমন হিসাবের সংখ্যা ৫ হাজার ২৮৭। আর পাঁচ হাজার টাকা থেকে শুরু করে এক কোটি টাকার কম আমানত রেখেছেন এমন আমানতকারীর হিসাব রয়েছে ৪ লাখ ২৫ হাজার ৯৩৪টি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যত আমানত ছিল, তার প্রায় ৫৫ শতাংশই রয়েছে মাত্র সোয়া এক শতাংশ আমানতকারীর হিসাবে। আর পৌনে ৯৯ শতাংশ আমানতকারীর হিসাবে ছিল মোট আমানতের সাড়ে ৪৪ শতাংশ। অর্থাৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৪ লাখ ২৫ হাজার ৯৩৪ জন আমানতকারী মিলে জমা রেখেছেন ১৯ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা। তার বিপরীতে মাত্র ৫ হাজার ২৮৭ জন আমানতকারী জমা রেখেছেন ২৪ হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদেরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন যে দেশে বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। একশ্রেণির মানুষ রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে অর্থবিত্তের মালিক হয়ে উঠছেন। তার বিপরীতে উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাওয়ায় মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্তসহ বিপুল জনগোষ্ঠীর সঞ্চয়ে টান পড়ছে। দেশে বৈষম্য এখন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, সেটিকে চরম উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা। তাই বৈষম্য কমাতে ধনীদের ওপর কর বাড়ানোর প্রস্তাব করে আসছেন তাঁরা।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফল পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, গত কয়েক দশকে দেশের আর্থসামাজিক অনেক সূচকে ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। মানুষের জীবনমানের উন্নতির পাশাপাশি আয়ও বেড়েছে। তবে সম্পদের বণ্টনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অন্যায্যতা রয়েছে। ফলে ধনী–গরিবের বৈষম্য প্রকট হচ্ছে। আয়বৈষম্য যে ক্রমেই বাড়ছে, তার প্রতিফলন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমানো আমানতের পরিসংখ্যানেও উঠে এসেছে। একদিকে সীমিত ও মধ্যম আয়ের মানুষের আয় কমছে, অন্যদিকে ব্যবসায়ীসহ প্রভাবশালীদের অর্থবিত্ত বাড়ছেই। অন্তর্ভুক্তিমূলক যে সমাজের প্রত্যাশা আমরা করছি, এই প্রবণতা তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যেসব আমানত রয়েছে, তার প্রায় এক–পঞ্চমাংশই রয়েছে এক থেকে পাঁচ কোটি টাকার হিসাবধারীদের মধ্যে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় এ রকম আমানত হিসাবের সংখ্যা ৪ হাজার ১৪৮। এসব হিসাবে গত ডিসেম্বর শেষে জমা অর্থের পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা, যা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট আমানতের ১৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। আর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অর্থ রয়েছে ৫ থেকে ১০ কোটি টাকার আমানতকারীর হিসাবে। গত ডিসেম্বর শেষে এ ধরনের আমানত হিসাব ছিল ৬৬৯টি। এসব হিসাবে জমা মোট আমানতের পরিমাণ ছিল প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা, যা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মোট আমানতের ১১ শতাংশ। অর্থাৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে গত বছর শেষে যত আমানত ছিল, তার ৩০ শতাংশই রয়েছে ১ থেকে ১০ কোটি টাকা জমা রেখেছেন এমন আমানত হিসাবে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় যে আমানত রয়েছে, তার মধ্যে ব্যক্তিশ্রেণির আমানত যেমন আছে, তেমনি রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক আমানতও। ফলে কোটি টাকার বেশি আমানত যেসব হিসাবে রয়েছে, তার সবই ব্যক্তিশ্রেণির আমানত নয়, প্রাতিষ্ঠানিক আমানতও রয়েছে এর মধ্যে।
সরকারি পরিসংখ্যানেও উঠে এসেছে দেশের প্রকট বৈষম্যের তথ্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএসের তথ্য বলছে, দেশের সবচেয়ে বেশি ধনী ১০ শতাংশ মানুষের হাতেই এখন দেশের মোট আয়ের ৪১ শতাংশ। অন্যদিকে সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষের আয় দেশের মোট আয়ের মাত্র ১ দশমিক ৩১ শতাংশ। এ তথ্য বিবিএসের খানার আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২-এ উঠে এসেছে। একই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈষম্যের নির্দেশক গিনি সহগ সূচক বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে দশমিক ৪৯৯ পয়েন্টে। কোনো দেশে এ সূচক দশমিক ৫০০ পয়েন্ট পেরোলেই সেই দেশকে উচ্চ বৈষম্যের দেশ হিসেবে ধরা হয়। অর্থাৎ উচ্চ বৈষম্যের দেশের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে বাংলাদেশ।
এদিকে, ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে করা বিবিএসের প্রথম খানার আয় ও ব্যয় জরিপ অনুযায়ী ওই সময় দেশের সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ মানুষের হাতে ছিল দেশের মোট আয়ের ২৮ দশমিক ৪ শতাংশ। ১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরের জরিপে দেখা যায়, ১০ শতাংশ উচ্চধনীর হাতে দেশের মোট সম্পদের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩১ শতাংশে। ২০১০ সালে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৩৬ শতাংশে। এর পর থেকে দেশের সবচেয়ে ধনীশ্রেণির আয়ের অংশীদারত্ব দ্রুত বেড়েছে। ২০১৬ সালে দেশের মোট আয়ের ৩৮ শতাংশই ছিল শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনীর হাতে। ২০২২ সালে এসে তা আরও বেড়ে হয়েছে ৪০ দশমিক ৯২ শতাংশ। তাদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ মানুষের আয় এখন দেশের মোট আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ।
বিবিএসের হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে, দেশের তিন ভাগের দুই ভাগ আয় পুঞ্জীভূত ধনী ৩০ শতাংশ মানুষের হাতে। বাকি ৭০ শতাংশ মানুষের আয় মোট আয়ের বাকি এক ভাগ।
ধনী–গরিবের এ বৈষম্য কমাতে হলে ধনীদের ওপর বেশি হারে করারোপ করতে হবে বলে মনে করেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, আমাদের দেশে সম্পদের পুনর্বণ্টনব্যবস্থা খুবই দুর্বল। সাধারণত আর্থিক নীতির মাধ্যমে এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সে ব্যবস্থা নেই। বরং আর্থিক নীতির বেশি সুবিধা পান ধনীরা। তাই ধনী-গরিবের বৈষম্য কমাতে হলে ধনীদের সম্পদের ওপর করারোপের পাশাপাশি তাদের করের পরিমাণও বাড়াতে হবে। তা না হলে এ ধরনের পরিস্থিতি অর্থনীতির অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করবে।