দেশের এক–চতুর্থাংশ ব্যাংক এখন বিশেষ তদারকির আওতায়। তবে ‘তদারকি মডেল’ কার্যত ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করছেন কোনো কোনো কর্মকর্তা।
কোনো ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতির অবনতি হলে বা অবনতির আশঙ্কা থাকলে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। দুর্বল ব্যাংকগুলোতে পর্যবেক্ষকের পরিবর্তে সমন্বয়ক নিয়োগ দেওয়া শুরু হয় গত বছরের জুলাইয়ে, বর্তমান গভর্নরের যোগদানের পর থেকে।
পর্যবেক্ষক ও সমন্বয়ক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বিভিন্ন সভায় যোগদানের পাশাপাশি সার্বক্ষণিক তদারকি করে আসছেন। এরপরও গত এক বছরে বিশেষ তদারকিতে থাকা বেশির ভাগ ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
দেশের এক–চতুর্থাংশ বা ১৫টি ব্যাংক এখন এমন বিশেষ তদারকির আওতায় রয়েছে। এই তদারকির কাজে যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাঁদের বাড়তি ভাতাও দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, তদারকির আওতায় থাকা একাধিক ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাহিদামতো তারল্য জমা রাখছে না, বন্ধ হয়নি এদের ঋণের অনিয়মও।
এসব ব্যাংকের মালিক ও গ্রাহকদের বেশির ভাগ সরকারঘনিষ্ঠ। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে, এটা বড় প্রশ্ন।মুস্তফা কে মুজেরী, সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংক
এসব ব্যাংকের বাইরে আরও তিনটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক ও কিছু বেসরকারি ব্যাংক অনিয়মের কারণে সংকটে পড়েছে। কিন্তু এরপরও কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের বিশেষ তদারকির আওতায় আনছে না। এসব কারণে ‘তদারকি মডেল’ কার্যত ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করছেন কোনো কোনো কর্মকর্তা। ফলে এসব ব্যাংক কোন উপায়ে সঠিক পথে ফিরবে, তা কেউ বলতে পারছেন না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের উচ্চপর্যায়ের ইঙ্গিত ছাড়া ব্যাংক খাত সঠিক পথে ফিরবে না। কারণ, এসব ব্যাংকের মালিকানার সঙ্গে জড়িত ও বড় গ্রাহকদের অনেকে প্রভাবশালী ও সরকারঘনিষ্ঠ। তাঁদের অনেকে সরকারের পদেও রয়েছেন। ফলে তাঁদের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো নীতি প্রয়োগ করছে না। এর ফলে অনেক ভালো ব্যাংক দিন দিন খারাপ হয়ে পড়ছে। আমানতকারীদের স্বার্থে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না।
তদারকিতে থাকা ১৫ ব্যাংকের মধ্যে ৭টি চলছে সমন্বয়ক দিয়ে। এই ব্যাংকগুলো হচ্ছে ন্যাশনাল ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, এবি ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল)। এ ছাড়া পর্যবেক্ষক বসানো হয়েছে ৮ ব্যাংকে—সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক। এসব ব্যাংকের মধ্যে গত এক বছরে (জুলাই ২০২২-জুন ২০২৩) ১২টিতেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে। আবার নতুন নতুন ঋণ অনিয়মের ঘটনাও ঘটেছে। আর খেলাপি ঋণ কমেছে শুধু বেসিক ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংকের।
রাতারাতি কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়। পর্যবেক্ষক ও সমন্বয়কেরা নতুন অনিয়ম ঠেকাতে ভূমিকা নিচ্ছেন। আগে যা অনিয়ম হয়েছে, তাতে এসব ঋণ এখন খেলাপি হলে তাঁদের কী করার আছে।মেজবাউল হক, মুখপাত্র, বাংলাদেশ ব্যাংক
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্ত পূরণ করতে ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণ কমানোর নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে বেশির ভাগ ব্যাংক তা পালন করতে পারছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, পর্যবেক্ষক-সমন্বয়ক দিয়ে ব্যাংকগুলোর খুব বেশি উন্নতি ঘটানোর সুযোগ নেই। কারণ, তাঁদের হাতে কোনো ক্ষমতা নেই। ফলে তাঁরা ভূমিকাও রাখতে পারছেন না। বাংলাদেশ ব্যাংক সত্যিকার অর্থে এসব ব্যাংকের উন্নতি চাইলে নিয়মনীতি পরিপালনে বাধ্য করলেই যথেষ্ট। এ জন্য কার ব্যাংক, কারা গ্রাহক—এসব বিবেচনায় নেওয়া যাবে না। গুণগত পরিবর্তন আনতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সক্রিয় হতে হবে। এতেই আমানতকারীদের অর্থের সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে।
মুস্তফা কে মুজেরী আরও বলেন, এসব ব্যাংকের মালিক ও গ্রাহকদের বেশির ভাগ সরকারঘনিষ্ঠ। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে, এটা বড় প্রশ্ন। এ জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাংক খাত ভালো করতে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
পর্যবেক্ষক-সমন্বয়ক দিয়ে ব্যাংকগুলোর খুব বেশি উন্নতি ঘটানোর সুযোগ নেই। কারণ, তাঁদের হাতে কোনো ক্ষমতা নেই। ফলে তাঁরা ভূমিকাও রাখতে পারছেন না। বাংলাদেশ ব্যাংক সত্যিকার অর্থে এসব ব্যাংকের উন্নতি চাইলে নিয়মনীতি পরিপালনে বাধ্য করলেই যথেষ্ট।বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে যোগ দেওয়ার পর গত বছরের ৪ আগস্ট আব্দুর রউফ তালুকদার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যাংকগুলোকে চিহ্নিত করতে চারটি চলক ঠিক করে সেগুলোর ভিত্তিতে ১০টি ব্যাংক চিহ্নিত করা হয়েছে। চলকগুলো হচ্ছে শ্রেণিকৃত ঋণের মাত্রা, মূলধন পর্যাপ্ততা, ঋণ-আমানত অনুপাত ও নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণের পরিমাণ। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো তিন বছর মেয়াদি ব্যবসায়িক পরিকল্পনা দেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রতিটি ব্যাংকের অগ্রগতি পর্যালোচনা করবেন। তবে গত কয়েক বছরে যেসব ব্যাংকে বড় ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে, সেগুলোকে দুর্বল ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত করেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তবে গত এক বছরে সাতটি ব্যাংককে দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত করে এসব ব্যাংকে সমন্বয়ক নিয়োগ দেওয়া হয়। অবশ্য এসব ব্যাংকে আগে থেকেই পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেওয়া ছিল। সমন্বয়কেরা এসব ব্যাংকের পর্ষদে সরাসরি যোগ দিতে পারেন না। তবে ব্যাংকের সব নথিপত্র দেখতে ও তদারক করতে পারবেন। আগে পর্যবেক্ষকেরা এসব ব্যাংকের পর্ষদ, নির্বাহী কমিটি ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় অংশ নিতেন।
গত এপ্রিল-জুন সময়ে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। ফলে জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকায়।
সমন্বয়কদের প্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকা ভাতা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক, যাঁরা সবাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তা। প্রতি সমন্বয়কের জন্য রয়েছে দুজন সহকারী। তাঁরাও পান প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সমন্বয়ক থাকা দেশীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণের হারে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা পদ্মা ব্যাংকের।
ব্যাংকটি ফারমার্স ব্যাংক নামে ২০১৩ সালে কার্যক্রম শুরু করে। মালিকদের নানা অনিয়মের কারণে নাম পরিবর্তন করে এটি পদ্মা ব্যাংক হয়েছে। মালিকানায় যুক্ত হয়েছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো। তবে খুব বেশি উন্নতি হয়নি, এখনো বড় প্রতিষ্ঠানগুলো জমা রাখা টাকা ফেরত পাচ্ছে না। ব্যাংকটির ঋণের এখনো প্রায় দুই–তৃতীয়াংশই (৬৩.৬৫%) খেলাপি। তবে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ গত এক বছরে ৩ হাজার ৯৫০ কোটি থেকে সামান্য কমে ৩ হাজার ৬৭২ কোটিতে নেমেছে।
এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা পদক্ষেপের ফলে ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণও ৯ হাজার ৩৯৪ কোটি থেকে ৩ কোটি টাকা কমেছে। বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণও ৮ হাজার ২৪৯ কোটি থেকে কমে ৮ হাজার ২৫ কোটি টাকায় নেমেছে।
তবে এবি ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, কমার্স ব্যাংক ও বিডিবিএলের উন্নতি হয়নি। এবি ব্যাংকে বেনামি ঋণের ঘটনা ধরা পড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনেই। ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ৪ হাজার ৩৪৫ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ৫ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা। ওয়ান ব্যাংকেরও খেলাপি ঋণ ২ হাজার ৭৯৩ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৮৩১ কোটি টাকা। কমার্স ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৯৮৪ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা ও বিডিবিএলের খেলাপি ঋণ ৭৬৭ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ৯৭১ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক নিজেও বেসিক ব্যাংকের সমন্বয়ক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাতারাতি কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়। পর্যবেক্ষক ও সমন্বয়কেরা নতুন অনিয়ম ঠেকাতে ভূমিকা নিচ্ছেন। আগে যা অনিয়ম হয়েছে, তাতে এসব ঋণ এখন খেলাপি হলে তাঁদের কী করার আছে। আমরা কোনো অনিয়ম দেখলে একটি প্রতিবেদন জমা দিতে পারি, প্রশাসনিক কোনো পদক্ষেপ নিতে পারি না। যা করার, সব সংশ্লিষ্ট বিভাগকে করতে হবে।’
কোনো ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতির অবনতি হলে বা অবনতির আশঙ্কা থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশ আগে থেকেই পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়ে আসছে। একসময় পর্যবেক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা অনেক কর্মকর্তা অবসরের পর সেই ব্যাংকে যোগদানও করেছেন। পর্যবেক্ষকেরা এসব ব্যাংকের পর্ষদ, নির্বাহী কমিটি ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় অংশ নেন। এসব পর্যবেক্ষককে প্রতি মাসে প্রতি মাসে ২৫ হাজার টাকা ভাতা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তাঁরা সবাই পরিচালক ও নির্বাহী পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তা। প্রতি পর্যবেক্ষকের জন্য রয়েছে দুজন সহকারী। তাঁরাও পান প্রতি মাসে ৮ হাজার টাকা করে।
পর্যবেক্ষক আছে এমন ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা জনতা ব্যাংকের। ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ এক বছরে ১৭ হাজার ২৬৩ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ২৮ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা। অ্যাননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপ—এই দুই ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে নিয়ে সংকটে আছে ব্যাংকটি। আবার বড় গ্রাহক বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণ দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার কোটি টাকায়। পাশাপাশি বড় গ্রাহকের তালিকায় আরও আছে এস আলম, থার্মেক্স ও রতনপুর গ্রুপ।
জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুল জব্বার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিছু বড় গ্রাহকের ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। এসব ঋণ ইতিমধ্যে নিয়মিত করা হয়েছে। ফলে ভবিষ্যতে খেলাপি ঋণ কমে আসবে।’
অগ্রণী ব্যাংকও একইভাবে বড় ও প্রভাবশালী বড় কয়েকজন গ্রাহককে ঋণ দিয়ে আটকে গেছে। এসব ঋণ এখন নিয়মিত থাকলেও ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে ব্যাংকটি। অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ এক বছরে ১০ হাজার ৫৫৭ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ১৬ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা। আর রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ এক বছরে ৬ হাজার ৪৬৫ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ৮ হাজার ৩৮ কোটি টাকা। এদিকে সোনালী ব্যাংকে আগে বড় ধরনের অনিয়মের ঘটনা ঘটলেও নতুন করে এমন ঘটনার কথা শোনা যাচ্ছে না। ব্যাংকটি এখন বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলোকে এড়িয়ে চলছে। ছোট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে লেনদেন ও ট্রেজারি ব্যবসা করে আয় বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে সোনালী ব্যাংক।
এদিকে কৃষি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ এক বছরে ২ হাজার ৬২৫ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা। আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৬৮০ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৯২ কোটি টাকা।
গত বছরের নভেম্বরে ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে বড় ধরনের অনিয়মের ঘটনা আলোচনায় আসার পর ব্যাংক দুটিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তখন থেকে ব্যাংক দুটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চাহিদামতো নগদ জমা (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) রাখতে পারছে না। এর মধ্যে জনতা ব্যাংকের আলোচিত গ্রাহক অ্যাননটেক্স গ্রুপের একটি বন্ধ কারখানায় ৭০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক। এ ছাড়া আরও কিছু প্রতিষ্ঠানে নতুন করে ঋণ ছাড় করেছে ব্যাংক দুটি। অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিযুক্ত পর্যবেক্ষক এতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না। ফলে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে না।
এদিকে গত এক বছরে ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪ হাজার ৫১০ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ৫ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ এক বছরে মাত্র ১ কোটি টাকা বেড়ে ১ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা হয়েছে। তবে এসব তথ্যের যথার্থতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারাই।
পর্যবেক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংকটি যে কীভাবে চলছে, তা দায়িত্ব না পেলে জানতে পারতাম না। পরিচালনা পর্ষদের বেশির ভাগ সভা হয় না। ভুয়া নথিপত্র তৈরি করে সভা দেখানো হয়েছে, সেখানে নানা ঋণ অনুমোদনও হয়েছে। এখন আমার পক্ষে কতটা সম্ভব এসব সামাল দেওয়া? কোনো অনিয়ম দেখলে আমি লিখিতভাবে সংশ্লিষ্ট বিভাগে জানিয়ে দিচ্ছি। সেই বিভাগ কোনো পদক্ষেপ না নিলে আমার কোনো করণীয় নেই। এর মধ্যে আমার চাকরির মেয়াদও শেষ হয়ে যাবে।’
এদিকে তদারকির বাইরে থাকা ব্যাংকগুলোতেও খেলাপি ঋণ বাড়ছে। নানা ধরনের ছাড় দিয়েও ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ কমাতে সফল হয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। গত এপ্রিল-জুন সময়ে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। ফলে জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকায়। এই খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা মোট ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। গত মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন দেশে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। এখন তা দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়াল। অর্থাৎ ১৪ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৭ গুণ। এই সময়টা ছিল ঋণখেলাপিদের জন্য সুবর্ণ সময়। তাদের জন্য বছর বছর নানা ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপরও তারা ঋণ শোধ করেনি; বরং নতুন নতুন ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে।