বাংলাদেশ ব্যাংক

সুদহারের নতুন যুগে বাংলাদেশ

কোনো সুদ আরোপ করার পর ছয় মাসের মধ্যে তা পরিবর্তন করা যাবে না। এর মধ্যে সুদহার বাড়লেও ব্যাংক গ্রাহকের সুদ বাড়াতে পারবে না।

ব্যবসায়ী ও ব্যাংকমালিকদের দাবির মুখে চালু হওয়া ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা থেকে বেরিয়ে এল বাংলাদেশ। সুদহার নির্ধারণে নতুন নিয়ম চালু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই নিয়মে সব ধরনের ব্যাংকঋণের সুদহার বাড়ছে। সুদহার নির্ধারণ হবে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদের ওপর। সেই গড় সুদ কত হবে, তা-ও জানিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। এর ফলে কৃষি, এসএমই, ব্যক্তিগত ও গাড়ি ঋণসহ সব ধরনের ঋণের সুদহার বাড়বে, যা কার্যকর হবে ১ জুলাই থেকে।

এর মাধ্যমে সুদহারের নতুন যুগে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ। ২০২০ সালের এপ্রিলের আগে সুদহার ছিল পুরোপুরি মুক্ত। তখন ব্যাংকঋণের সুদ ১৬-১৭ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছিল। এরপর ৯ শতাংশ সুদহারে নির্দিষ্ট ছিল। ১ জুলাই থেকে সীমা প্রত্যাহার করা হচ্ছে, তবে উন্মুক্ত না। ফলে সুদহার পুরোপুরি বাঁধা থাকল তিন বছর তিন মাস। নতুন নিয়মে নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় চলবে সুদ নির্ধারণের ব্যবস্থা।

এমনিতেই আগামী অর্থবছরে সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধি পাবে, বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে আসবে। তার ওপর ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে ব্যবসার তহবিল খরচকে বৃদ্ধি করবে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি সামীর সাত্তার
বাংলাদেশ ব্যাংক

বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল সোমবার সুদহার নির্ধারণ–সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়, ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদের হার হবে ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ। যার নাম দিয়েছে ‘সিক্স মানথ মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল’ (ট্রেজারি বিলের ছয় মাসের চলমান গড়) বা স্মার্ট রেফারেন্স রেট। প্রতি মাসের প্রথম কার্যদিবসে এই হার ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সার্বিক অর্থনীতির গতিধারা অব্যাহত রাখা ও দক্ষ ঋণ ব্যবস্থাপনার নিশ্চিত করতে ব্যাংকগুলোতে বাজারভিত্তিক সুদহার ব্যবস্থা চালুর জন্য এই নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।

সুদহার ধরে রাখার বিষয় না। এত দিন ধরে রেখেছিল, এখন ধীরে বাজারভিত্তিক করা হচ্ছে। এটা ভালো উদ্যোগ।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার গত রোববার মুদ্রানীতি ঘোষণা অনুষ্ঠানে বলেন, ‘যখন সুদহার ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ ছিল, তখন ব্যবসার খরচ কমাতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে সুদহার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছিল। তখন বিদেশি ঋণ ২ শতাংশ সুদে পাওয়া যেত। আবার সুদ হার পরিবর্তনের প্রয়োজনটি আমরা রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বোঝাতে সক্ষম হওয়ায় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই আবার ঋণের সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা তুলে দেওয়া হচ্ছে।’

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুদহার ধরে রাখার বিষয় না। এত দিন ধরে রেখেছিল, এখন ধীরে বাজারভিত্তিক করা হচ্ছে। এটা ভালো উদ্যোগ। একেবারে ছেড়ে দিলে একসঙ্গে অনেক বৃদ্ধি পেয়ে ব্যবসার খরচ বাড়িয়ে দিত। এমনিতেই ডলার–সংকটের কারণে ব্যবসায়ীরা নানা সমস্যায় আছে। নতুন হিসাবে সুদ গণনা করতে ব্যাংকগুলোকে একটু ঝামেলা পোহাতে হবে। গ্রাহকদেরও বিষয়টি বুঝতে সময় লাগবে। তবে ভালো খবর হলো, অবশেষে সুদহারের সীমা তুলে নেওয়া হয়েছে।’

ব্যাংকঋণের সুদহার হবে ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ। আর অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি (সিএমএসএমই) ও ভোক্তা ঋণের আওতাধীন ব্যক্তিগত ঋণ ও গাড়ি ক্রয় ঋণে আরও ১ শতাংশ তদারকি মাশুল যুক্ত করে সুদহার হবে ১১ দশমিক ১৩ শতাংশ। কৃষি ও পল্লি ঋণের সুদহার হবে ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ।

কোন ঋণে কত সুদ

২০২০ সালের এপ্রিলে ঋণের সুদহারের সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সীমা বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর ব্যাংকগুলোতে আমানতের সুদ কমাতে শুরু করলে কিছু আমানতের ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির সমান সুদ দিতে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক। যা নয়ছয় সুদহার নামে পরিচিত পায়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গতকালের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদের হারের সঙ্গে ৩ শতাংশ মার্জিন যোগ করে ঋণের সুদহার নির্ধারণ করা হবে। অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি (সিএমএসএমই) ও ভোক্তা ঋণের আওতাধীন ব্যক্তিগত ঋণ ও গাড়ি ক্রয় ঋণে আরও ১ শতাংশ তদারকি মাশুল যুক্ত হবে। কৃষি ও পল্লি ঋণের সুদহার নির্ধারণ করা হবে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদের হারের সঙ্গে ২ শতাংশ মার্জিন যোগ করে। চলতি মাসে ট্রেজারি বিলের গড় সুদের হার ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ।

ফলে ব্যাংকঋণের সুদহার হবে ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ। আর অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি (সিএমএসএমই) ও ভোক্তা ঋণের আওতাধীন ব্যক্তিগত ঋণ ও গাড়ি ক্রয় ঋণে আরও ১ শতাংশ তদারকি মাশুল যুক্ত করে সুদহার হবে ১১ দশমিক ১৩ শতাংশ। কৃষি ও পল্লি ঋণের সুদহার হবে ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ।

বর্তমানে কৃষিঋণে সুদহার ৮ শতাংশ। অন্য ঋণে সুদহার ৯ শতাংশ। আর ক্রেডিট কার্ডে সুদহার আগের মতো ২০ শতাংশ বহাল থাকবে।

সুদ গণনা হবে যেভাবে

বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, কোনো সুদ আরোপ করার পর ছয় মাসের মধ্যে তা পরিবর্তন করা যাবে না। এর মধ্যে সুদহার বাড়লেও ব্যাংক গ্রাহকের সুদ বাড়াতে পারবে না। আবার সুদহার কমলেও গ্রাহকের সুদ কমবে না। পাশাপাশি সুদহার স্থির বা পরিবর্তনশীল যে প্রকৃতির হোক না কেন, গ্রাহকের সম্মতি নিয়ে নতুন সুদ নির্ধারণ করতে হবে। পরিবর্তনশীল প্রকৃতির সুদহার প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রতি ছয় মাস পরপর তা পরিবর্তন করা যাবে। কোন নতুন ঋণ দেওয়া ক্ষেত্র সংশ্লিষ্ট মাসের জন্য সুদহার কার্যকর হবে।

ব্যাংকের আর্থিক কর্মকর্তারা বলছেন, ঋণের সুদ বেড়ে গেলেও ছয় মাস আগে পরিবর্তন করা যাবে না। এটা ব্যাংকের সম্পদ-দায় ব্যবস্থাপনায় বিঘ্ন ঘটাবে। সুদ কম হওয়ায় এতে ব্যাংকগুলোর আমানত হারাবে।

নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো ঋণ মেয়াদের আগে সমন্বয় করতে চাইলে সিএমএসএমই ও ভোক্তা ঋণের আওতাধীন ব্যক্তিগত ঋণ ও গাড়ি ক্রয়ের ঋণের ক্ষেত্রে ১ শতাংশ তদারকি মাশুল আনুপাতিক হারে আদায় করতে হবে। ফলে বছরের মাঝখানে কেউ ঋণ শোধ করে দিতে চাইলে, তাঁর ঋণের ওপর দশমিক ৫০ শতাংশ হারে তদারকি মাশুল নিতে পারবে ব্যাংক।

প্রচলিত ব্যাংকের পাশাপাশি ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোকেও একই নিয়মে মুনাফা হিসাব করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, সুদহারে ৯ শতাংশ সীমা দেওয়ার পর কিছু ব্যবসায়ী তাদের সুদ কমিয়ে তা মওকুফ করে নেন। বাংলাদেশ ব্যাংক তার অনুমোদন দেয়। এখন সেই প্রয়োজন শেষ হয়ে যাওয়ায় সীমা প্রত্যাহার করে নতুন নিয়ম চালু করা হচ্ছে। এতে ভুক্তভোগী হচ্ছেন সাধারণ আমানতকারীরা। কোনো কোনো ব্যাংক ২-৩ শতাংশ সুদ দিচ্ছে, অথচ মূল্যস্ফীতি এখন ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ।

চাপে পড়বেন ব্যবসায়ীরা, খুশি ব্যাংকাররা

সুদহারের নতুন নিয়ম চালু হওয়ার খরচ বাড়বে ব্যবসায়ীদের। বর্তমান সংকটের সময়ে যা বাড়তি চাপ তৈরি করবে বলে মনে করছেন তাঁরা। যেমন মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. বশির উদ্দিন প্রথম বলেন, সুদহার বেড়ে যাওয়া মানে ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচও বেড়ে যাওয়া। তাতে ব্যবসায়ীদের লগ্নির খরচ বেড়ে যাবে।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি সামীর সাত্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমনিতেই আগামী অর্থবছরে সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধি পাবে, বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে আসবে। তার ওপর ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে ব্যবসার তহবিল খরচকে বৃদ্ধি করবে। আর অর্থায়ন ব্যয় বাড়লে নতুন বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হতে পারে। এতে করে আমদানিনির্ভরতা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।'

তবে সীমা প্রত্যাহার হওয়ায় খুশি ব্যাংকাররা। অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সুদহার বাজারভিত্তিক করার পথে বাংলাদেশ ব্যাংক। এটা খুব ভালো উদ্যোগ। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সুদ নির্ধারণেও নতুন মডেল চালু করেছে। এতে সব সুদহার আগের চেয়ে অনেক বেশি বাজারভিত্তিক হবে। এর ফলে ব্যাংকগুলোর সম্পদ-দায় ব্যবস্থাপনা সহজ হবে।