টানা পাঁচ দিন ধরে ইন্টারনেট অচল ও লেনদেন বন্ধ থাকার কারণে আমদানি বিল পরিশোধ নিয়ে কিছুটা চাপের মুখে পড়েছে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। অনেক বিদেশি ব্যাংক ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান বিলম্বে বিল পরিশোধের দায়ে বাড়তি অর্থ চাইছে, যাকে জরিমানা বা সুদ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। তবে কোনো কোনো ব্যাংক দেশের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বাড়তি অর্থ দেওয়া থেকে ছাড় পেয়েছে এবং গত বৃহস্পতিবার আমদানি দায় শোধ করেছে।
দেশের শীর্ষ ১০টি ব্যাংকের বৈদেশিক বাণিজ্য কার্যক্রমে যুক্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে। হঠাৎ ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ায় অর্থ লেনদেন-সংক্রান্ত বার্তা আদান-প্রদানের বৈশ্বিক ব্যবস্থা সুইফট থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বাংলাদেশ। এই সময়ে বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সব ধরনের আর্থিক লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়।
কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভের পর সংঘাত শুরু হলে ১৯ জুলাই শুক্রবার মধ্যরাত থেকে দেশে কারফিউ জারি করা হয়। তবে আগের দিন বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকেই ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে দেওয়া হয়। জানা গেছে, নিরাপত্তা বিবেচনায় বাংলাদেশের সঙ্গে লেনদেন করে, এমন অনেক বিদেশি ব্যাংক বাংলাদেশি ব্যাংকগুলোর হিসাব অকার্যকর করে দেয়। ফলে বন্ধের মধ্যে কোনো লেনদেন সম্পন্ন হয়নি। গত বুধবার সীমিত পরিসরে ইন্টারনেট ও ব্যাংক চালু হলেও আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেন করতে পারেনি অনেক ব্যাংক।
এখন প্রশ্ন উঠছে, সময়মতো বিল পরিশোধ না করার জন্য যদি বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়, তাহলে সেই দায় কে নেবে। ব্যাংকাররা বলছেন, এই দায় শেষ পর্যন্ত গ্রাহকদের নিতে হবে। তবে ব্যবসায়ী গ্রাহকেরা পাল্টা যুক্তি দিয়ে বলছেন, ব্যাংক সময়মতো অর্থ পরিশোধ না করতে পারলে তার দায় কোনোভাবেই গ্রাহকের ওপর চাপানো যাবে না।
অর্থের লেনদেন হয় বাংলাদেশের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক ও বিদেশে থাকা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকের মধ্যে। কোনো দায় পরিশোধ করতে হলে বাংলাদেশের ব্যাংক বিদেশে থাকা তাদের নস্ট্রো হিসাব থেকে রপ্তানিকারকের ব্যাংকে অর্থ পাঠাতে আদেশ দেয়। এই আদেশ দেওয়া হয় সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশনের (সুইফট) মাধ্যমে। দেশের ব্যাংকগুলোর বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে নস্ট্রো হিসাব পরিচালনা করে। রপ্তানির অর্থ এবং প্রবাসী আয়ও একই পদ্ধতিতে দেশে আসে।
১৮ জুলাই দুপুরে ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে দেওয়ার আগেই যেসব ব্যাংক আমদানি দায় পরিশোধের জন্য আদেশ দিতে সক্ষম হয়, তাদের সেই আদেশ কার্যকর হয়। ব্যাংকগুলো সাধারণত আগেই জানিয়ে রাখে কোন সময়ে দায় পরিশোধের বার্তা দেওয়া হবে। জানা গেছে, ঢাকার স্থানীয় সময় দুপুরের পর কোনো আদেশ না পেয়ে ও অস্থিরতার খবর জেনে অনেক বিদেশি ব্যাংক বাংলাদেশের হিসাবগুলো অকার্যকর করে দেয়। বৃহস্পতিবার দুপুরের পর সুইফট সিস্টেম থেকে বিচ্ছিন্ন হয় দেশের ব্যাংকগুলো। এতে ১৮-২৩ জুলাই সময়ে বৈশ্বিক লেনদেনব্যবস্থায় কার্যত বাংলাদেশ যুক্ত ছিল না।
তিনটি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে বলেন, শুক্র ও শনিবার বাংলাদেশে ছুটি ছিল, আর রোববার ছিল অন্যান্য দেশে ছুটি। ফলে এ সময় লেনদেন বন্ধ থাকলেও তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু অনেক ব্যাংকের জন্য ঝামেলা তৈরি হয়েছে এর পরের তিন দিনের দায় পরিশোধ নিয়ে।
পোশাক খাতের ব্যাংকিং ব্যবসা করে বেসরকারি এক্সিম ব্যাংক। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ ফিরোজ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বৃহস্পতিবার সকালে আমদানি দায় পরিশোধের জন্য বিদেশি ব্যাংককে আদেশ পাঠিয়ে দিয়েছি। সকাল যেসব আদেশ দেওয়া হয়, সেদিনই তা পরিশোধ হয়ে যায়। বন্ধের সময়ে কোনো দায় পরিশোধ করা যায়নি। খোলার পর একসঙ্গে সব দায় শোধ করা হয়েছে। তবে এ জন্য কোনো জরিমানা দিতে হয়নি। আমরা বিদেশিদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। সাধারণত সময়মতো দায় পরিশোধ না করলে জরিমানা দিতে হয়।’
গত বুধবার ব্যাংক চালু হয়, ইন্টারনেটও ফিরে আসে। তবে এদিন সুইফট সিস্টেম চালু করতে পারেনি বেশির ভাগ ব্যাংক। ফলে বৈশ্বিক লেনদেনও করতে পারেনি। এদের ক্ষেত্রে ছয় দিন লেনদেন বন্ধ ছিল। বাংলাদেশের বিদেশি লেনদেনের ৯০ শতাংশের বেশি হয় মার্কিন ডলারে, যা নিউইয়র্কের বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। ইউরোপের সঙ্গে বেশির ভাগ লেনদেন হয় জার্মানির কমার্জ ব্যাংকের মাধ্যমে। ব্যাংকটি বাংলাদেশের সব ধরনের লেনদেন দুই সপ্তাহের জন্য বন্ধ করে রেখেছে। আরও কিছু বিদেশি ব্যাংক একই পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশে প্রতি মাসে সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলারের আমদানি দায় শোধ করে। রপ্তানি আয় হয় প্রায় সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার ও প্রবাসী আয়ের অর্থ আসে ২ থেকে আড়াই বিলিয়ন ডলার।
বেসরকারি খাতের মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় পাঁচ দিন সারা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের আর্থিক লেনদেন ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। সুইফট সিস্টেমও কাজ করেনি। এই সময়ে যেসব আমদানি দায় মেটানোর কথা ছিল, তা পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। এ জন্য পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে জরিমানা বা বাড়তি সুদ না নেওয়ার জন্য আমরা তাদের অনুরোধ করব। তারা না মানলে বাড়তি খরচসহ দায় শোধ করতে হবে। বাড়তি খরচ শেষ পর্যন্ত গ্রাহকের ওপরই বর্তাবে।’
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম এই দায় গ্রাহকের ওপর চাপানোর বিরোধিতা করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংক ও ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে আমদানি বিল সময়মতো পরিশোধ করা যায়নি। এর দায়দায়িত্ব কোনোভাবেই ব্যবসায়ীদের ওপর বর্তাবে না। যদি জরিমানা দিতে হয়, তাহলে ব্যাংক দেবে। কারণ, ব্যাংকের কাছে আমাদের অর্থ জমা ছিল, তারা সময়মতো বিল পরিশোধ করতে পারেনি।’