বেসরকারি খাতের প্রথম প্রজন্মের ন্যাশনাল ব্যাংক বিপুল পরিমাণ টাকা লোকসান দিয়েছে। গত বছরের বিভিন্ন প্রান্তিকে ব্যাংকটি লোকসানে পড়ার তথ্য প্রকাশ করেছিল। বছর শেষে সব ধরনের নিরীক্ষা শেষে জানা গেল, কেবল বিদায়ী বছরই ব্যাংকটি ৩ হাজার ২৬০ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। ফলে ২০২১ সালের মতো গত বছরের জন্যও শেয়ারধারীদের কোনো লভ্যাংশ না দেওয়ার সুপারিশ করেছে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ।
দেশের অনেক ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা খারাপ হলেও প্রকৃত তথ্য প্রকাশ হয় না বললেই চলে। এর মধ্যে বেসরকারি খাতের এই ব্যাংক বড় ধরনের লোকসানের তথ্য প্রকাশ করেছে। এর আগে কোনো বেসরকারি ব্যাংকে একক বছরে এত লোকসানের খবর মেলেনি। এর মাধ্যমে দেশের দুরাবস্থায় থাকা ব্যাংকের বাস্তব চিত্র বের হতে শুরু করেছে বলে খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান প্রথম আলোকে বলেন, কোনো বেসরকারি ব্যাংকের এত বড় লোকসানের খবর আগে শোনা যায়নি। এই লোকসানের চিত্র প্রকাশ একটা ভালো উদ্যোগ। কারণ, বাংলাদেশের অনেক ব্যাংকই প্রকৃত তথ্য গোপন করে চলছে। তথ্য গোপন করলে বিপর্যয় হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। প্রকৃত চিত্র প্রকাশে সমাধান আসতে পারে। এই ব্যাংক ভালো ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ছিল। ব্যাংক খাতের প্রথম অনেক সেবা ন্যাশনাল ব্যাংকের হাত দিয়ে এসেছিল।
আনিস এ খান বলেন, এখন প্রয়োজন ব্যাংকটির এমডিকে ক্ষমতা দিয়ে স্বাধীনভাবে পরিচালনা করার সুযোগ দেওয়া। এতে ব্যাংকের সব কর্মীদের অকুণ্ঠ সমর্থন দিতে হবে। ব্যাংকটির উন্নতি করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্বক্ষণিক তদারকি করতে হবে। তাহলেই আগের ধারায় ফিরবে এই ব্যাংক।
ব্যাংকটির বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, ২০২০ সালে ন্যাশনাল ব্যাংকের আমানত ছিল ৪৩ হাজার ৭৪ কোটি টাকা ও ঋণ ছিল ৪০ হাজার ৮৫১ কোটি টাকা। ২০২১ সালে আমানত ও ঋণ বেড়ে হয় যথাক্রমে ৪৭ হাজার ৩১০ কোটি টাকা ও ৪৪ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা। তবে ২০২২ সালে আমানত ও ঋণ দুটিই কমে গেছে। ২০২২ সাল শেষে আমানত কমে হয়েছে ৪২ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকা ও ঋণ কমে হয়েছে ৪২ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা।
ব্যাংকটির কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের ‘অযাচিত হস্তক্ষেপ ও প্রতি প্রান্তিকে লোকসানের তথ্য প্রকাশ করায়’ অনেকে আতঙ্কিত হয়ে আমানত সরিয়ে নিয়েছেন। এর প্রভাবে দৈনন্দিন কাজ চালাতে ব্যাংকটিকে অন্য ব্যাংক থেকে উচ্চ সুদে টাকা ধার করতে হয়েছে। অন্যদিকে ঋণের টাকাও আদায় হচ্ছে না। এর ফলে খরচ বাড়িয়ে লোকসান হয়েছে।
প্রথম আলোর সঙ্গে যে কর্মকর্তারা কথা বলেছেন, তাঁরা তাঁদের নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।
বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক একসময় ছিল সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনকারী ব্যাংক। তবে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, ব্যাংকটির মালিকপক্ষের নামে-বেনামে ঋণ ব্যাংকটিকে বিপদে ফেলেছে। ফলে দিনে দিনে বেড়ে চলছে খেলাপি ঋণ। ন্যাশনাল ব্যাংকের ২০২০ সালেও খেলাপি ঋণের হার ছিল ১০ শতাংশের নিচে। ২০২১ সালে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয় ৯ হাজার ২৬১ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ২০ দশমিক ৮০ শতাংশ।
বিদায়ী বছরে, অর্থাৎ ২০২২ সাল শেষে খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ। টাকার অঙ্কে খেলাপি ঋণের পরিমাণ হয়েছে ১০ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। এর ফলে খেলাপি ঋণের বিপরীতে বেশি পরিমাণ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হচ্ছে, যা ব্যাংকটিকে লোকসানে যেতে বাধ্য করেছে।
এদিকে ব্যাংকটি ২০২২ সালে চট্টগ্রামের একটি প্রভাবশালী গ্রুপ ও আরেকটি প্রতিষ্ঠানের ২ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করেছে। এর মধ্যে ব্যাংকটির খাতুনগঞ্জ ও গুলশান শাখার আওতাধীন ১৩টি প্রতিষ্ঠানের ২ হাজার ২৮২ কোটি টাকা সুদ মওকুফ করে দিয়েছে ব্যাংকটি। এসব সুদ গত বছরগুলোয় ব্যাংকটি তাদের আয়ের হিসাবে দেখিয়েছিল। আবার মুনাফা থেকে সরকারকে করও পরিশোধ করেছে। মুনাফাও বিতরণ করেছে। এখন সুদ মওকুফ করায় ব্যাংকটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্য হিসাব থেকে এই অর্থ সমন্বয় করতে হচ্ছে। ফলে বড় অঙ্কের লোকসানে পড়েছে।
জানা যায়, সুদ মওকুফ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগ চট্টগ্রামের একটি গ্রুপের। পাশাপাশি গ্রুপ-সংশ্লিষ্ট অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো হলো—পুষ্টি ভেজিটেবল, ফেয়ারি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, নাফ ট্রেডিং ও আদিল করপোরেশন। সুদ মওকুফের ফলে ব্যাংকটি তারল্য-সংকটেও পড়ে। অনেক শাখায় আমানত কমেছে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকে আমানতের বিপরীতে প্রয়োজনীয় পরিমাণ এসএলআর (বিধিবদ্ধ জমা) জমা রাখতে পারছে না ব্যাংকিট। এ জন্য মাঝেমধ্যে জরিমানা গুনতে হচ্ছে ন্যাশনাল ব্যাংককে।
গতকাল রোববার ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে ২০২২ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুমোদনের পর প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ মাসে ন্যাশনাল ব্যাংক শেয়ারপ্রতি লোকসান দিয়েছে ১০ টাকা ১৩ পয়সা। ৩ হাজার ২১৯ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের ব্যাংকটির শেয়ার সংখ্যা ৩২১ কোটি ৯৭ লাখ ৩৯ হাজার ৫৭০টি। এ হিসাবে লোকসান হয়েছে ৩ হাজার ২৬০ কোটি টাকা। ২০২১ সালে ব্যাংকটি মুনাফা করেছিল ৩৮ কোটি টাকা।
একসময় সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনকারী এই বেসরকারি ব্যাংক ২০১৭ সালে নিট মুনাফা করেছিল ৪৬৯ কোটি টাকা। ২০১৮–১৯ সালেও ৪০০ কোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছিল ব্যাংকটি। ২০২০ সালে মুনাফা কমে হয় ৩৪৮ কোটি টাকা। ২০২১ সালে যা একেবারে কমে হয় ৩৮ কোটি টাকা।
গত বছর বড় অঙ্কের এ লোকসানের কারণ হিসেবে ব্যাংকটি সুদ মওকুফ, খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি ও সুদ আয় কমে যাওয়াকে কারণ হিসাবে তুলে ধরেছে। মূল্য সংবেদনশীল তথ্য হিসেবে এ কথা ব্যাংকটির পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়েছে। এই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বেশির ভাগ সদস্য সিকদার গ্রুপ–সংশ্লিষ্ট।
২০২২ সালে ন্যাশনাল ব্যাংকের এই খারাপ অবস্থা কেন হলো, সে সম্পর্কে ব্যাংকটির বক্তব্য জানতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেহমুদ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাড়া দেননি।