যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেড দফায় দফায় সুদহার বাড়িয়েছে। ফলে বিদেশি ব্যাংক থেকে ডলার ধারে সুদ ৯ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে।
একে তো ডলারের সংকট, তারও আবার চড়া দাম। আর এখন নতুন করে বাড়তি বোঝা হয়ে এসেছে বিদেশি ব্যাংক থেকে ডলারে নেওয়া ঋণের সুদহার বৃদ্ধি। কারণ, ডলারের সুদহারের সঙ্গে যুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ (ফেড) ব্যবস্থার সুদ। গত বছরে ফেড ৭ দফায় সুদহার বাড়িয়েছে। ফলে বিদেশি ব্যাংক থেকে ডলার ধার করতে সুদহার বেড়ে ৯ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। এতে সরকারি-বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ পরিশোধও বেড়েছে।
এদিকে দেশের ব্যাংকগুলোকে ঋণ সুবিধা দেওয়া অনেক বিদেশি ব্যাংক সময়মতো পাওনা অর্থ না পেয়ে এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। অনেক ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন সীমাও কমিয়ে দিয়েছে তারা।
এমন পরিস্থিতিতে পণ্য আমদানিতে দুশ্চিন্তা বেড়েছে দেশের উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের। আর সবাই যে চাহিদামতো ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছে, তা-ও না। ব্যাংকের মালিকানায় থাকা ব্যবসায়ী ও বড় গ্রাহকেরা ছাড়া অন্যরা চাহিদামতো ঋণপত্র খুলতে পারছে না। এমনকি রমজানের আগে অতিপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য আনতেও তারা একই সমস্যায় পড়েছে।
ঋণপত্র খোলার অনেক চাহিদা আছে, আমরা খুলতে পারছি না।সৈয়দ মাহবুবুর রহমান, এমডি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক
যদিও জানুয়ারি মাসে ঋণপত্র খোলা আগের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। চলতি মাসের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ঋণপত্র খোলা হয়েছে ৩৬৩ কোটি ডলারের। গত ডিসেম্বরের পুরো সময়ে যা ছিল ৪১১ কোটি ডলার। যদিও ডলারের সংকট এখনো কাটেনি। তবে প্রবাসী আয় ও পণ্য রপ্তানি কিছু বেড়েছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফেডের সুদ বৃদ্ধির ফলে বিশ্বের প্রায় সব দেশই ভুগছে। তবে বাংলাদেশে ডলারের দামের সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দিয়ে ও ঋণের সুদহার বেঁধে রেখে সংকটকে আরও ত্বরান্বিত করা হচ্ছে। বাংলাদেশের মতো ডলারের চার ধরনের দাম আর কোথাও নেই।
বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্রে (এলসি) ও ঋণপত্র ছাড়া কয়েক ধরনের ব্যবস্থা আছে। ঋণপত্রের মাধ্যমে পণ্য আমদানিতে অন্যতম হলো সাইট এলসি। এর মাধ্যমে পণ্য আনতে সবচেয়ে কম সময়ে অর্থ পরিশোধ করতে হয়। পণ্য দেশে আসার আগেই পণ্য পাঠানোর নথিপত্র পেলেই পণ্যের মূল্য ও খরচ ডলারে পরিশোধ করে দিতে হয়। তবে এই ব্যবস্থায় কম আমদানি হয়। কারণ, কেউ নগদ বা কম সময়ে অর্থ পরিশোধ করতে চায় না। আবার ডলার-সংকটও বেড়েছে। মূলত এর মাধ্যমে খাদ্যপণ্য আমদানি হয়ে থাকে।
আর শিল্পের কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্র আমদানিতে প্রধান মাধ্যম বায়ার্স ক্রেডিট। এর আওতায় বিদেশি কোনো ব্যাংক আমদানি বিল পরিশোধ করে দেয়। নির্দিষ্ট সময় পরে দেশি ব্যাংক সেই দায় শোধ করে। এর মাধ্যমে মূলধনি যন্ত্র আনলে ৩৬০ দিনের মধ্যে আমদানি দায় শোধ করা যায়। কাঁচামালের ক্ষেত্রে পরিশোধের সর্বোচ্চ মেয়াদ ১৮০ দিন। আর এখন রমজান উপলক্ষে ভোজ্যতেল, ছোলা, ডাল, মটর, পেঁয়াজ, মসলা, চিনি ও খেজুর আমদানিতে বিল পরিশোধে ৯০ দিন পর্যন্ত সুযোগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ জন্য আমদানিকারকদের এখন ৯ শতাংশ পর্যন্ত সুদ গুনতে হচ্ছে।
ডলারের দাম ও ঋণের সুদহার ধরে রাখার কারণে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না।আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট
এদিকে সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের আওতায় ১৮০ দিন পর্যন্ত ঋণপত্রের মূল্য পরিশোধের সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে পণ্য সরবরাহকারী বিদেশি প্রতিষ্ঠান ১৮০ দিন বাকিতে পণ্য বিক্রি করে। ওই প্রতিষ্ঠানের মনোনীত ব্যাংক দেশের ব্যাংকের সঙ্গে তা সমন্বয় করে চুক্তি অনুযায়ী পরে সুদসহ অর্থ আদায় করে নেয়। তবে দেশীয় ব্যাংকগুলো প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে না পারায় এখন সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট কমে গেছে। আবার বাকিতে পণ্য সময়মতো অর্থ না পেয়ে দেশীয় আমদানিকারকদের ওপর বিদেশি অনেক সরবরাহকারী আস্থা হারিয়েছে।
ফলে এখন যে ঋণপত্র খোলা হচ্ছে, তার সবই বায়ার্স ক্রেডিটের আওতায়। এই ব্যবস্থায় পণ্য আমদানিতে প্রতিবছর বেশ সুদ গুনতে হয় বাংলাদেশকে।
বিদেশি ব্যাংক থেকে ডলার ধার করার ক্ষেত্রে আগে সুদহার নির্ধারণ হতো লন্ডন ইন্টার ব্যাংক অফারড রেট বা লন্ডন আন্তব্যাংক সুদের হারের (লাইবর) সঙ্গে মিল রেখে। এর পরিবর্তে এখন সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেটের (সোফর) সঙ্গে সাড়ে ৩ শতাংশ পর্যন্ত সুদ যুক্ত করে ঋণ নেওয়ার সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বিদায়ী বছরে যুক্তরাষ্ট্রের ফেড ৭ দফায় সুদহার বাড়িয়েছে। ফলে সোফরের রেটও বেড়েছে। যেমন গত বুধবার ৬ মাস মেয়াদে সোফরের সুদহার ছিল ৪ দশমিক ৮১ শতাংশ। এর সঙ্গে রয়েছে সাড়ে ৩ শতাংশ সুদ। পাশাপাশি ব্যাংকগুলো ১ শতাংশ পর্যন্ত খরচ ধরে থাকে। ফলে বিদেশি ব্যাংক থেকে ডলার ধার করতে ৯ শতাংশ পর্যন্ত সুদ গুনতে হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি খাত বিদেশি ব্যাংক ও অন্য উৎস থেকে যে ঋণ নিয়েছে, তারও সুদ বেড়েছে। অথচ গত বছরের জুলাইয়ে ৬ মাস মেয়াদে সোফরের সুদহার ছিল দশমিক ৪৩ শতাংশ।
‘খাদ্যপণ্য আনতে আগে সরবরাহকারীদের সঙ্গে চুক্তি করে ব্যাংকে যেতাম। এখন ব্যাংকের নথিপত্র হলেই পণ্য কেনার চুক্তি করছি। সব সময় ব্যাংক ডলার দিতে না পারায় চাহিদামতো ঋণপত্রও খুলছে না। এমন পরিস্থিতিতে পাঁচ-সাত দিনের মধ্যে রমজানের পণ্যের ঋণপত্র খোলা না গেলে সময়মতো খুচরা বাজারে পণ্য সরবরাহ কঠিন হয়ে পড়বে।’আবুল বশর চৌধুরী, চট্টগ্রামের বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান
জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘চলতি লেনদেন হিসাবে উন্নতি ছাড়া অন্য সমস্যা কেটেছে, এটা বলা যাবে না। ঋণপত্র খোলার অনেক চাহিদা আছে, আমরা খুলতে পারছি না। ফেডের সুদহার বৃদ্ধির ফলে যারা আগে বিদেশি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিল, তাদের খরচ বেড়ে গেছে। সরকারের ঋণের খরচও বেড়ে গেছে। এটা বাড়তে থাকলে আমদানিতে খরচ আরও বাড়বে। কারণ, আমদানির বড় অংশ বিদেশি ঋণনির্ভর। কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, বুঝতে পারছি না।
দেশে এখন প্রতি মাসে গড়ে যে পরিমাণ রপ্তানি ও প্রবাসী আয় আসছে, আমদানি খরচ হচ্ছে তার চেয়ে কম। এরপরও সংকট রয়ে গেছে। কারণ, আমদানির জন্য বিদেশি ব্যাংকগুলো আগে যে অর্থায়ন করেছে, তার দায় এখন শোধ করতে হচ্ছে। আবার সরকারি-বেসরকারি খাতে ঋণ পরিশোধ, বিদেশি কোম্পানির মুনাফা প্রত্যাবাসন, বিমানভাড়া, চিকিৎসাসেবাসহ নানা খরচ রয়েছে।
ফলে বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রতিনিয়ত রিজার্ভ ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে। আবার এখন যারা ঋণপত্র খুলছে, তাদের বেশির ভাগ দায় পরিশোধে ছয় মাস পর্যন্ত সময় নিচ্ছে। ফলে সামনে সংকট কেটে যাবে, এমন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ব্যাংকগুলো টাকা দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কিনছে, ফলে টাকার সংকটে পড়েছে অনেক ব্যাংক। ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ নির্দিষ্ট করে রাখায় আমানতের সুদও বাড়াতে পারছে না ব্যাংকগুলো। কমছে ব্যাংক আমানতও। সংকটে পড়ে কোনো কোনো ব্যাংক ৯ শতাংশের বেশি সুদেও অন্য ব্যাংক থেকে টাকা ধার করছে। এতে অনেক মানুষ ব্যাংকবিমুখও হচ্ছে।
দেশের শীর্ষ একটি গ্রুপের খাদ্যপণ্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ডাল ও ছোলা আমদানির জন্য দুই কোটি ডলারের ঋণপত্র খুলতে কয়েক দিন ধরে একটি ব্যাংকে ধরনা দিচ্ছে। বেসরকারি একটি ব্যাংকের গুলশান শাখায় তাদের ৫০০ কোটি টাকার ঋণসীমাও মঞ্জুর করা আছে। তবে ব্যাংকটি গত বুধবার শেষ পর্যন্ত তাদের এক কোটি ডলারের ঋণপত্র খুলেছে।
গ্রুপটির একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, খাদ্যপণ্য আনতে ভুগতে হলে ব্যবসা চলবে কীভাবে। রমজানের আগে চাহিদামতো খাদ্যপণ্য আনতে সরকারের বিশেষ সেল গঠন জরুরি হয়ে পড়েছে।
এ তো গেল শীর্ষ গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠানের ভোগান্তি। ছোট ও মাঝারিদের অবস্থা আরও খারাপ। ব্যাংকগুলো এখন প্রসাধনসামগ্রী, ইলেকট্রনিক পণ্য, বেকারি ও বেভারেজ পণ্যের ঋণপত্র তেমন খুলছে না। এমনকি অনেকে কাঁচামাল আনতেও ঋণপত্র খুলতে পারছে না। ফলে অনেকে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে ফেলছে। এদিকে ডলার-সংকট কাটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণপত্রগুলো যাচাই-বাছাই করছে। অপ্রয়োজনীয় মনে করলেই আটকে দিচ্ছে। আর দামে কমবেশি হলে জরিমানা করছে ব্যাংকারদের।
চট্টগ্রামের বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘খাদ্যপণ্য আনতে আগে সরবরাহকারীদের সঙ্গে চুক্তি করে ব্যাংকে যেতাম। এখন ব্যাংকের নথিপত্র হলেই পণ্য কেনার চুক্তি করছি। সব সময় ব্যাংক ডলার দিতে না পারায় চাহিদামতো ঋণপত্রও খুলছে না। এমন পরিস্থিতিতে পাঁচ-সাত দিনের মধ্যে রমজানের পণ্যের ঋণপত্র খোলা না গেলে সময়মতো খুচরা বাজারে পণ্য সরবরাহ কঠিন হয়ে পড়বে।’
বাংলাদেশ ব্যাংক এখন ব্যাংকগুলোর কাছে প্রতি ডলার ১০২ টাকা দামে বিক্রি করছে। আর ব্যাংকগুলো রপ্তানিকারকদের কাছে প্রতি ডলার বিক্রি করছে ১০২ টাকায়। প্রবাসী আয় কিনছে ১০৭ টাকায়। ফলে আমদানিতে খরচ হচ্ছে প্রায় ১০৫ টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৩২ বিলিয়নের কিছু বেশি। তবে এর ৮ বিলিয়ন ব্যবহারযোগ্য নয়। ২০২১ সালের আগস্টেও রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছিল।
গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ডলারের দাম ও ঋণের সুদহার ধরে রাখার কারণে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। অনেকে কাঁচামাল আনতে না পেরে কারখানা বন্ধ করে দিচ্ছেন। এদিকে কারও নজর নেই। আমলারা সিদ্ধান্ত নিলে এর চেয়ে ভালো আর কী হবে।
আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, ঋণের সুদহারের সীমা তুলে দিলে ডলারের দাম একটা জায়গায় গিয়ে স্থির হয়ে যেত। এমন সিদ্ধান্ত নিতে যত দেরি হবে, ক্ষতি হবে তত বেশি। একটা কারখানা বন্ধ হওয়া সহজ, কিন্তু নতুন কারখানা গড়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা তার চেয়ে অনেক কঠিন। তাই সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়কে এসব বিষয়ে নজর দিতে হবে।