দুই দফায় ছয় বছর দায়িত্ব শেষে এমডি মোহাম্মদ শামস-উল-ইসলামের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত বুধবার।
গত ছয় বছরে রাষ্ট্রমালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংকে যুক্ত হয়েছে দেশের শীর্ষ একাধিক গ্রুপ। তাদের ঋণ দিতে অন্য ব্যাংককে নিয়ে জোট গঠন করেছে ব্যাংকটি। নেতৃত্বও দিয়েছে বেশ কয়েকটিতে। এ ছাড়া আরও অনেক ভালো গ্রাহককেও যুক্ত করেছে। তবে এরপরও ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এই সময়ে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন মোহাম্মদ শামস-উল-ইসলাম। দুই দফায় ছয় বছর দায়িত্ব শেষে তাঁর মেয়াদ শেষ হয়েছে গত বুধবার।
গত ছয় বছরের মেয়াদকালে শামস-উল-ইসলামের সঙ্গে দেশের প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের বেশ সখ্য গড়ে ওঠে। এ কারণে তৃতীয় মেয়াদে তাঁকে নিয়োগের জন্য প্রভাবশালী অনেক ব্যবসায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকে তদবির করেন। আবার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে বিভিন্ন দুর্বল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে টাকা ধার দিয়ে সমালোচিতও হন তিনি।
নিজের কাজের মূল্যায়ন জানতে চাইলে মোহাম্মদ শামস-উল-ইসলাম গত বৃহস্পতিবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত ছয় বছরে আমি ব্যাংকটিকে একটা পর্যায়ে রেখে এসেছি। অনেক ভালো গ্রুপ এখন অগ্রণী ব্যাংকের গ্রাহক। দেশের একমাত্র স্বর্ণ পরিশোধনাগার, ১৫টি বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রসহ একাধিক প্রকল্পে অর্থায়ন করা হয়েছে। যার সুফল পাবে ব্যাংকটির পরবর্তী প্রজন্ম।’
২০১৬ সালের জুলাইয়ে অগ্রণী ব্যাংকের তৎকালীন এমডি সৈয়দ আবদুল হামিদকে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর ওই বছরের ২৪ আগস্ট এমডি হিসেবে নিয়োগ পান মোহাম্মদ শামস-উল-ইসলাম। এর আগে তিনি আনসার ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংকের এমডি ছিলেন।
২০১৬ সালে ব্যাংকটির আমানত ছিল প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা, গত বছর শেষে তা বেড়ে এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। একই বছরের সেপ্টেম্বর ব্যাংকটির ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ২৯২ কোটি টাকা, গত জুনে যা বেড়ে হয়েছে ৬১ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা। আর একই সময়ের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ ৫ হাজার ৭১১ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১০ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা। ফলে ছয় বছরে আমানত বেড়েছে
দ্বিগুণ, ঋণ বেড়েছে ৩ গুণ আর খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ।
গত ছয় বছরে ব্যাংকটির গ্রাহক হিসেবে নতুন করে যুক্ত হয়েছে প্রাণ-আরএফএল, পিএইচপি, ব্র্যাক, আব্দুল মোনেম, ক্রাউন সিমেন্ট, নোমান গ্রুপ, আবুল খায়ের গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠান। ভালো মানের বড় এসব করপোরেট গ্রাহক যুক্ত হওয়ায় ব্যাংকটিতে প্রাণ ফিরেছে। তাতে ব্যাংকটি বড় ধরনের ঋণে ঝুঁকেছে।
গত বছর শেষে ব্যাংকটির বড় অঙ্কের ঋণের পরিমাণ ছিল ২৩ হাজার ৭৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৭ শতাংশ। অগ্রণী ব্যাংক ২৪টি বড় সিন্ডিকেট ঋণে অংশ নিয়েছে, এর মধ্যে ১১টিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে। জোটবদ্ধভাবে ব্যাংকটি ৭ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। বসুন্ধরা ও ওরিয়ন গ্রুপের মতো বড় প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া জোটবদ্ধ ঋণে নেতৃত্ব দেয় অগ্রণী ব্যাংক।
ব্যাংকটি বড় গ্রাহকদের ঋণের পাশাপাশি অর্থবাজারেও (মানি মার্কেট) আগ্রাসী আচরণ করেছে। অনেক দুর্বল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা খাটায়। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে গত ২৬ মে ইউনিয়ন ব্যাংককে ১০০ কোটি টাকা ধার দেয় অগ্রণী ব্যাংক। এতে সুদ ধরা হয় ৮ শতাংশ। আর জুনে ন্যাশনাল ব্যাংককে কয়েক দফায় দেয় ৪০০ কোটি টাকা। যার সুদ হার ছিল সাড়ে ৭ থেকে ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ। একই সময়ে ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদে কমার্স ব্যাংককে দিয়েছে ৫০ কোটি টাকা।
যখন অনেক ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা রেখে বিপদে আছে, তখন অগ্রণী ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও নতুন করে টাকা খাটিয়েছে। ৮ থেকে সাড়ে ৮ শতাংশ সুদে আভিভা ফাইন্যান্সে (সাবেক রিলায়েন্স ফাইন্যান্স) ৪৫ কোটি টাকা ও স্ট্র্যাটেজিক ফাইন্যান্সে ১৫০ কোটি টাকা খাটায়। আর আগে থেকেই আরও ৯ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ব্যাংকটির ৪০৯ কোটি টাকা ছিল, যা এখন ফেরত পাচ্ছে না।
শামস-উল-ইসলাম এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ সুদ বেশি দেখেই এসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে টাকা ধার দেওয়া হয়েছে। আমি না থাকলেও এই টাকা ফেরত আসবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর শেষে ব্যাংকটির বিতরণ করা ৭০ শতাংশ ঋণই কোটি টাকার বেশি অঙ্কের। সোনালী ব্যাংকে যেখানে ৫ লাখ টাকার বেশি ঋণ ১৯ শতাংশ, সেখানে অগ্রণী ব্যাংকের এমন ঋণ মাত্র ৯ শতাংশ। তবে খেলাপি ঋণে সোনালী ও জনতার চেয়ে পিছিয়ে আছে অগ্রণী ব্যাংক।
২০২১ সালে ব্যাংটি শীর্ষ ২০ খেলাপি গ্রাহক থেকে ২৪০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল, তবে আদায় হয়েছে মাত্র ৩৯ কোটি টাকা। তবে অন্য খেলাপি থেকে গত বছরে ১৮০ কোটি টাকা আদায় করেছে ব্যাংকটি—লক্ষ্য ছিল ৩৬০ কোটি টাকা। ব্যাংকটি খেলাপি ঋণ আদায় করতে না পেরে ৫ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা অবলোপন বা খেলাপির হিসাব থেকে আড়াল করেছে। সেই ঋণ থেকে গত বছরে আদায় হয়েছে ৭৪ কোটি টাকা।
২০২১ সালে ব্যাংকটি ৬৪৮ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করে। তবে অধিক খেলাপি ঋণের নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখার কারণে শেষ পর্যন্ত নিট মুনাফা হয় ১৩৭ কোটি টাকা। ২০২০ সালে ১৪ কোটি টাকা নিট লোকসানে ছিল ব্যাংকটি। অবশ্য এ জন্য ব্যাংকটিকে ৫ হাজার ২৪ কোটি টাকা নিরাপত্তা সঞ্চিতি বিলম্বে সংরক্ষণের সুযোগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ব্যাংকটি সুদ থেকে যে আয় করছে, তার বেশি সুদ ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। ২০২১ সালে ঋণের সুদ থেকে আয় ছিল ৩ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা, তবে আমানতকারীদের সুদ দিতে হয়েছে ৪ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা। ২০২১ সালে পাঁচবার জরিমানা গুনতে হয়েছে ব্যাংকটিকে। এতে খরচ হয়েছে ২৫ লাখ টাকা। খেলাপি গ্রাহককে ঋণ দেওয়া, ঋণ তথ্য ব্যুরোতে ভুল তথ্য দেওয়ায় এই জরিমানা গুনতে হয়েছে।
জানতে চাইলে অগ্রণী ব্যাংকের নতুন এমডি মুরশেদুল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘দায়িত্ব নেওয়ার পর বলতে পারব ব্যাংকটির অবস্থা কী। সবার সহযোগিতা নিয়ে ভালোভাবে ব্যাংকটি চালাতে চাই।’