প্রবাসী আয় কেনার প্রতিযোগিতা, বদলে গেছে দৃশ্যপট

নিজস্ব অ্যাকাউন্ট বা হিসাব রয়েছে এমন ব্যাংকের মাধ্যমে এখন রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় পাঠানোর প্রবণতা কমছে; বরং যেই ব্যাংক ডলারপ্রতি যত বেশি দাম দেয়, সেটির মাধ্যমে তত বেশি পরিমাণে প্রবাসী আয় আসছে। পাশাপাশি দেশে–বিদেশে নেটওয়ার্ক বেশি বিস্তৃত—এমন ব্যাংকগুলো প্রবাসী আয় সংগ্রহে কিছুটা সুবিধা পাচ্ছে।

দেশে ডলার–সংকটের কারণে প্রবাসী আয় কেনা নিয়ে ব্যাংকগুলোর মধ্যে এখন প্রতিযোগিতা চলছে। যেসব ব্যাংক বেশি দামে কেনার সুযোগ পাচ্ছে বা যাদের ডলারের চাহিদা বেশি, তারা প্রবাসী আয়ের বেশি ডলার কিনছে।

এদিকে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো প্রবাসী আয় সংগ্রহে পিছিয়ে পড়ছে। কারণ, এসব ব্যাংকে ডলার বেশি খরচ হয় সরকারি আমদানির জন্য। সরকার কিন্তু ডলারে বাড়তি দাম দিতে রাজি না। তাই এসব ব্যাংক বেশি দামে ডলার কিনতে পারছে না।

 মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমানও এর সঙ্গে একমত। তিনি প্রথম আলোকেলেন, ‘এখন যে বেশি দাম দেয়, সে–ই বেশি প্রবাসী আয় পায়। যাদের চাহিদা বেশি, তারা বেশি দামে ডলার কিনে নেয়। পাশাপাশি যেসব ব্যাংকের নেটওয়ার্ক বেশি, তারা কিছুটা সুবিধা পায়। তবে প্রবাসী আয় পাওয়ার সঙ্গে ব্যাংকের আর্থিক সূচকের সম্পর্ক খুবই কম।’

প্রবাসী আয় যেভাবে আসে

প্রবাসী আয়ের বড় অংশ এখনো বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোর মাধ্যমে আসে। পাশাপাশি কিছু প্রবাসী নিজেরাই বিদেশি অ্যাপ ব্যবহার করে দেশে আয় পাঠিয়ে থাকেন। আবার কেউ কেউ এই লোকগুলোর সহায়তায় দেশে আয় পাঠান। এ জন্য ব্যাংক হিসাব বা মুঠোফোন নম্বর ব্যবহার করা হয়। এ ক্ষেত্রে সুবিধাভোগীর মুঠোফোন নম্বরে একটি পিন নম্বর যায়।

এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো জমা হওয়া অর্থ বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর কাছে দামাদামির ভিত্তিতে বিক্রি করে। যে ব্যাংক বেশি দাম দেয়, সেই ব্যাংকই বেশি ডলার পায়। আর যেসব প্রবাসী মুঠোফোন নম্বরের মাধ্যমে আয় পাঠান, তাঁদের আত্মীয়রা পিন নম্বর দেখিয়ে ওই এক্সচেঞ্জ হাউসের সঙ্গে চুক্তি আছে—এমন ব্যাংকের যে কোনো শাখা থেকে টাকা তুলতে পারেন।

অর্থ স্থানান্তরের জন্য বিভিন্ন দেশে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন, মানিগ্রাম, রিয়া, ট্রান্সফাস্ট, আল রাজি এক্সচেঞ্জের মতো কয়েক শ এক্সচেঞ্জ হাউস রয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর মালিকানাধীন ও বাংলাদেশি নাগরিকদের মালিকানাধীন এক্সচেঞ্জ হাউসও রয়েছে। সব ধরনের এক্সচেঞ্জ হাউসের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর চুক্তি রয়েছে। যেসব ব্যাংকের সঙ্গে বেশি এক্সচেঞ্জ হাউসের চুক্তি রয়েছে, তারা বাড়তি সুবিধা পায়।

যেভাবে পাল্টাল দৃশ্যপট

দেশে ৪২ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন প্রবাসী আয় এসেছে গত সেপ্টেম্বরে। ওই মাসে বৈধ পথে দেশে প্রবাসী আয় আসে ১৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ডলার। এর আগে সর্বশেষ ২০২০ সালের এপ্রিলে প্রবাসী আয় এসেছিল ১০৯ কোটি ডলার। তবে ডলারের দাম বেশি দেওয়ার ফলে গত অক্টোবর মাসে প্রবাসী আয়ে বড় উত্থান ঘটে। এ মাসে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ১৯৭ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ বেশি এবগত চার মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ

ব্যাংকভিত্তিক তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, আগে প্রবাসী আয় সংগ্রহে ইসলামী ব্যাংক ছিল শীর্ষে। পরের জায়গাটিতে ছিল অগ্রণী ব্যাংক, যেটি এখন দশম স্থানে নেমে গেছে। পাশাপাশি সরকারি খাতের সোনালী ব্যাংক আর জনতা ব্যাংকও এখন তালিকার শীর্ষ দশে নেই। অন্যদিকে এমন কিছু ব্যাংকের আয় অস্বাভাবিক বেড়েছে, যাদের দেশের সব জেলায় শাখাও নেই। দাম বেশি দেওয়ার কারণেই মূলত এসব ব্যাংকের আয় অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে বলে মনে করা হয়।

জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আবদুল জব্বার প্রথম আলোকেলেন, ‘ডলারের দাম বেশি না দেওয়ায় আমাদের প্রবাসী আয় কমে গেছে। দাম যেখানে বেশি, আয় সেখানে চলে যাচ্ছে। আর বেশি দামে ডলার কিনে কম দামে বিক্রি করতে হলে আমাদের লোকসান হবে। আমরা সরকারের নিয়ম মেনে চলছি। সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক বিব্রত হয়, এমন কিছু করছি না।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, বেসরকারি প্রিমিয়ার ব্যাংকের মাধ্যমে আগস্টে ২১ লাখ ও সেপ্টেম্বরে ৪৪ লাখ ডলার আয় এলেও অক্টোবরে তা বেড়ে হয় ৪ কোটি ৮৪ লাখ ডলার। ইস্টার্ণ ব্যাংকের মাধ্যমে আগস্টে ৩ কোটি ৪২ লাখ, সেপ্টেম্বরে ২ কোটি ৮২ লাখ ও অক্টোবরে ৬ কোটি ৮৪ লাখ ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে।

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক আগস্টে ১ কোটি ৯৩ লাখ, সেপ্টেম্বরে ১ কোটি ৪৭ লাখ ও অক্টোবরে ২ কোটি ৬৬ লাখ ডলারের প্রবাসী আয় সংগ্রহ করেছে। দি সিটি ব্যাংকের মাধ্যমে আগস্টে ৯২ লাখ, সেপ্টেম্বরে ৫৮ লাখ এবং অক্টোবরে ১১ কোটি ২ লাখ ডলার এসেছে।

কয়েকটি ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, কড়াকড়ির কারণে সেপ্টেম্বরে ব্যাংকগুলো বেশি দামে ডলার কিনতে পারেনি। ফলে যাদের নেটওয়ার্ক ভালো, তারা কিছু আয় পেয়েছে। অক্টোবরে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবাসী আয় কেনায় ছাড় দেওয়ায় ব্যাংকগুলো মোটামুটি তাদের চাহিদা অনুযায়ী প্রবাসী আয় কিনেছে, যা এখনো চলছে।

ডলার-সংকট মোকাবিলায় প্রবাসী ও রপ্তানি আয়ে ডলারের দাম ৫০ পয়সা বাড়ানো হয়েছে। গত বুধবার থেকে উভয় ক্ষেত্রেই প্রতি ডলার ১১০ টাকা ৫০ পয়সা করা হয়েছে। তবে কোনো কোনো ব্যাংক ১২২ টাকা দরেও প্রবাসী আয় আনছে। তবে আমদানিকারকদের কাছে ডলার বিক্রির আনুষ্ঠানিক দাম ১১১ টাকা।

গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) ও ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) যৌথ সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক দামে বড় ব্যবধানের কারণে ব্যাংকগুলোতে ডলারের ‘শ্যাডো মার্কেট’ বা ‘ছায়া বাজার’ ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে, যা ব্যাংকারদের অনৈতিক পথে ঠেলে দিচ্ছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট অনেকে।