ডলারের বাজার অস্থিতিশীল

দেশি–বিদেশি ছয় ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানদের অব্যাহতি

ব্যাংকগুলো হলো দেশের বেসরকারি খাতের প্রাইম, ব্র্যাক, দি সিটি, ডাচ্‌–বাংলা, সাউথইস্ট ব্যাংক এবং বিদেশি খাতের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক।

  • ট্রেজারি বিভাগ ব্যাংকের টাকা ও ডলারের জোগান ও চাহিদার বিষয়টি নিশ্চিত করে থাকে।

  • বাংলাদেশ ব্যাংকে ডলারের দাম ৩০ পয়সা বেড়ে হয়েছে ৯৫ টাকা। আর খোলাবাজারে ১১৫ টাকা।

ডলার

দেশি-বিদেশি ছয় ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, মার্কিন ডলারের বাজার অস্থিতিশীল করে অতিরিক্ত মুনাফা করায় এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ব্যাংক ছয়টি হলো দেশের বেসরকারি খাতের প্রাইম, ব্র্যাক, দি সিটি, ডাচ্‌–বাংলা ও সাউথইস্ট ব্যাংক এবং বিদেশি খাতের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক।

ট্রেজারি বিভাগ ব্যাংকের টাকা ও ডলারের জোগান ও চাহিদার বিষয়টি নিশ্চিত করে থাকে। সরিয়ে দেওয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে ট্রেজারি বিভাগের প্রধান পদে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তাও রয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক পরিদর্শন করে এসব ব্যাংকের ডলার কেনাবেচার তথ্য পর্যালোচনা করে। পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, কোনো কোনো ব্যাংক ডলার কেনাবেচা করে এক মাসে ৪০০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা করেছে। যার মাধ্যমে ডলারের বাজারকে আরও অস্থিতিশীল করে তোলা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সামনে আরও ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

ডলার বিক্রি করে অস্বাভাবিক মুনাফা করেছে কয়েকটি ব্যাংক। এ জন্য তাদের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
সিরাজুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র

গত এক দশকে একসঙ্গে শীর্ষ পর্যায়ের ছয় ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সরিয়ে দেওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম। ২০০২ সালে ওম প্রকাশ আগরওয়াল নামের এক ব্যবসায়ী জালিয়াতির মাধ্যমে পাঁচটি ব্যাংক থেকে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। ওই ঘটনায় একসঙ্গে পাঁচ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) অপসারণ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ডলার বিক্রি করে অস্বাভাবিক মুনাফা করেছে কয়েকটি ব্যাংক। এ জন্য তাদের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

আমদানি খরচ বাড়ায় গত মে মাস থেকে দেশে ডলারের সংকট চলছে। রপ্তানি ও প্রবাসী আয় দিয়ে আমদানি দায় শোধ করা যাচ্ছে না। এর ফলে বেড়ে গেছে ডলারের দাম। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম এই সময়ে ৮৬ টাকা থেকে ৯৫ টাকা নির্ধারণ করেছে। তবে ব্যাংকগুলো প্রবাসী আয় আনছে ১১২ থেকে ১১৩ টাকায়। আর রপ্তানি বিল নগদায়ন হচ্ছে ১০৪ থেকে ১০৫ টাকায়। ফলে আমদানিকারকদের কাছে প্রতি ডলারের জন্য ১০৭ থেকে ১০৮ টাকা নিচ্ছে ব্যাংকগুলো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন,‘ডলার তো কোনো কাঁচামাল নয় যে মজুত করে অতিরিক্ত মুনাফা করবে। ডলার কেনাবেচায় দামের পার্থক্য ন্যূনতম করে তা নিশ্চিত করতে হবে। বাজার অস্থিতিশীল করলে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা পর্ষদ কাউকেই ছাড় দেওয়া যাবে না।’

‘গত দুই দিনে ১১১ থেকে ১১২ টাকা দাম দিয়েও কোনো প্রবাসী আয় আনতে পারিনি। আর রপ্তানি আয় নগদায়ন হচ্ছে ১০৩ থেকে ১০৪ টাকায়। ফলে ১০৭ থেকে ১০৮ টাকায় ডলার বিক্রি না করলে আমাদের লোকসান হয়ে যাবে। এই কারণে যদি শাস্তি হয়, তাহলে কিছু করার নেই। মেনে নিতে হবে। তবে আমরা এর ব্যাখ্যা দেব।’
এম কামাল হোসেন, সাউথইস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক

কেন এমন পরিস্থিতি

ডলারের সংকট শুরু হলে গত জুন মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক পরিদর্শক দল দেশি-বিদেশি ব্যাংকগুলোতে পরিদর্শন করে। এতে দেখা যায়, ব্যাংকগুলো ডলারের ক্রয় ও বিক্রয়ের যে ঘোষণা দিয়েছে, বাস্তবে তার চেয়ে অনেক বেশি দামে কেনাবেচা করছে।

ডলার কেনাবেচায় দামের পার্থক্য (স্প্রেড) তিন টাকা ছাড়িয়ে গেছে। আবার অনেক ব্যাংক ডলার ধারণের মিথ্যা তথ্য দিয়েছে। এর মাধ্যমে বেশি দামে ডলার বিক্রি করে ট্রেজারি বিভাগ মুনাফায় অস্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলোর জবাব চেয়ে চিঠি পাঠায় বৈদেশিক মুদ্রা পরিদর্শন বিভাগ।

এর ধারাবাহিকতায় গতকাল ছয় ব্যাংকের এমডিদের কাছে পাঠানো চিঠিতে ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ব্যাংক ছয়টির এমডিদের কাছে পাঠানো চিঠিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক লিখেছে, ‘২০২১ সালের জানুয়ারি-মে মেয়াদের তুলনায় ২০২২ সালের একই সময়ে বৈদেশিক বাণিজ্য এবং বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে উচ্চ মুনাফা অর্জনের জন্য বৈদেশিক বাজারকে অস্থিতিশীল করা হয়েছে। এ জন্য আপনাদের ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হলো।’

ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ডলারে মুনাফা করা যাবে না, এমন নিষেধাজ্ঞা কোথাও নেই। রিজার্ভ থেকে যে ডলার বিক্রি করা হয়েছে, তা–ও বেশি দামে বিক্রি করা হয়নি। বেশি দামে ডলার কিনে বেশি দামে বিক্রি করা হয়েছে। আর বেশি মুনাফা হয়েছে ব্যাংকের কাছে ডলার মজুত থাকার কারণে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সময়মতো টাকার মান না কমিয়ে ডলারকে দুর্বল করে রেখেছে। ফলে এখন সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। এর দায় পড়ছে ব্যাংকগুলোর ওপর। বাংলাদেশ ব্যাংক সময়মতো টাকার অবমূল্যায়ন করলে এ ধরনের সমস্যা দেখা দিত না।

সাউথইস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম কামাল হোসেন পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত দুই দিনে ১১১ থেকে ১১২ টাকা দাম দিয়েও কোনো প্রবাসী আয় আনতে পারিনি। আর রপ্তানি আয় নগদায়ন হচ্ছে ১০৩ থেকে ১০৪ টাকায়। ফলে ১০৭ থেকে ১০৮ টাকায় ডলার বিক্রি না করলে আমাদের লোকসান হয়ে যাবে। এই কারণে যদি শাস্তি হয়, তাহলে কিছু করার নেই। মেনে নিতে হবে। তবে আমরা এর ব্যাখ্যা দেব।’

বাড়ল ডলারের দাম

বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল মার্কিন ডলারের দাম আরও এক ধাপ বাড়িয়েছে। এতে কমেছে টাকার মান। এর ফলে প্রতি ডলারের দাম ৩০ পয়সা বেড়ে হয়েছে ৯৫ টাকা। আগে যা ছিল ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা। এ দামে রিজার্ভ থেকে ১৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক এ দামকে বলছে আন্তব্যাংক দর।

তবে এ দামে ব্যাংকগুলোতে কোনো ডলার লেনদেন হচ্ছে না। ব্যাংকগুলো গতকাল প্রবাসী আয় এনেছে ১১২ থেকে ১১৩ টাকা দামে। এ দামে আমদানিকারকদের কাছে ডলার বিক্রি করেছে। আর খোলাবাজারেও মানি চেঞ্জারগুলো প্রতিটি ডলার বিক্রি করেছে ১১৫ টাকা দরে। ফলে ডলারের দামের পার্থক্য দাঁড়িয়েছে ২০ টাকা, যা এযাবৎকালের সর্বোচ্চ।

এদিকে বিদেশে যেতে ইচ্ছুকেরা যাতে ব্যাংক থেকে ডলার কিনতে পারেন, এ জন্য ব্যাংকগুলোর সঙ্গে সভা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলো জানিয়েছে, তাদের কাছে ১ কোটি ১০ লাখ নগদ ডলার মজুত আছে।

অন্য সময়ে থাকে ৩ কোটি ডলারের বেশি। এসব ডলার দেওয়া হয় তাদের নিজস্ব গ্রাহকদের। পাশাপাশি কার্ডে ডলার খরচের বিষয়ে গ্রাহকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। ফলে যেকোনো নাগরিকের ব্যাংক থেকে ডলার দেওয়ার সুযোগ কম।

এদিকে চলতি মাসের প্রথম সাত দিনে ৫৫ কোটি ডলার প্রবাসী আয় এসেছে। আমদানি কমায় এবং প্রবাসী ও রপ্তানি আয় বাড়ায় ডলার–সংকট কেটে যাওয়ার আশা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ছয় শীর্ষ ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কারণ, ট্রেজারি প্রধানেরাই ডলার সংগ্রহে প্রধান ভূমিকা রাখেন। ট্রেজারি প্রধানদের ছাড়া ব্যাংকের কার্যক্রম কীভাবে চলবে, এ নিয়েও জটিলতায় পড়েছে ব্যাংকগুলো।