বিএফআইইউর সাবেক ও বর্তমান একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, ১০ বছর আগেও যাঁদের নিয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদন করা যেত, এখন তা কল্পনাও করা যায় না।
বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের অভিযোগ নতুন বিষয় নয়। এটি নতুন করে আলোচনায় এসেছে ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারে “এস আলম’স আলাদিন’স ল্যাম্প” (এস আলমের আলাদিনের চেরাগ) শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের সূত্র ধরে। বাংলাদেশের অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইন, ২০১২ অনুযায়ী অনুমোদন ছাড়া বিদেশে বিনিয়োগ নিষিদ্ধ। এই অপরাধের শাস্তি সর্বোচ্চ ১২ বছর কারাদণ্ড এবং যে পরিমাণ অর্থ পাচার করা হয়েছে, তার দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থদণ্ড।
কিন্তু অর্থ পাচার নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গবেষণা করে, এমন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রতিনিয়তই জানাচ্ছে যে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ নানাভাবে পাচার হচ্ছে। ফলে দেশ থেকে অর্থ পাচার ঠেকাবে কে, পাচারকারীদের ধরবেই–বা কে—এই প্রশ্ন নতুন করে উঠেছে। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে পাচার হওয়া অর্থ বিদেশ থেকে ফেরত আনার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, তবে কেউ সেই সুযোগ নেয়নি।
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের বাইরে বিনিয়োগের জন্য এখন পর্যন্ত ১৭টি প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দিয়েছে, তবে তাতে চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের নাম নেই। ফলে তারা কোনো অর্থ বিদেশে বিনিয়োগ করলে তার কোনো অনুমোদন ছিল না বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। সর্বশেষ, সংবাদপত্রে প্রকাশিত অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য উচ্চ আদালত–সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছে।
অর্থ পাচার বন্ধের দায়দায়িত্বের বিষয় উঠলে প্রথমেই আসে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) নাম। এটি বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট নামেও পরিচিত।
আইন অনুযায়ী, এই ইউনিট অর্থ পাচার প্রতিরোধে সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করে। এটি সরকারের স্বতন্ত্র সংস্থা হিসেবে অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন প্রতিরোধে ভূমিকা পালন করে। তবে বিএফআইইউ কোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নয়, এটি শুধু আর্থিক গোয়েন্দা প্রতিবেদন তৈরি করতে পারে। এরপর সরকারের অপরাধ প্রতিরোধকারী সংস্থা তথা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগসহ (সিআইডি) সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার কাছে তা পাঠিয়ে থাকে। অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা এসব সংস্থারই। এসব সংস্থায় অন্যান্য অপরাধের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যবস্থার কথা শোনা গেলেও বড় ব্যবসায়ীদের অর্থ পাচার নিয়ে কাজ করার বিষয়টি বেশ বিরল।
এই দুই সংস্থার পাঁচজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক বা বিএফআইইউর সহায়তা ছাড়া অর্থ পাচারের বিষয়ে তদন্ত করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, এসব বিষয়ে তাঁদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ও প্রযুক্তি অবকাঠামোর স্বল্পতা আছে। যেহেতু আর্থিক লেনদেনগুলো ব্যাংকের মাধ্যমে হয় এবং ব্যাংকের অর্থই বেশি পাচার হয়, তাই তাঁদেরই এ বিষয়ে উদ্যোগী হতে হবে। বিএফআইইউ আগে বড় ব্যবসায়ীদের অর্থ পাচার নিয়ে নানা তথ্য পাঠাত, এখন তা প্রায় বন্ধ। ছোট আর্থিক অপরাধ নিয়েই এখন বিএফআইইউ বেশি ব্যস্ত। ফলে অর্থ পাচার বাড়ছে, কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া যাচ্ছে না।
সাম্প্রতিক সময়ে ধীরে ধীরে বিএফআইইউর কাজের পরিধি বেড়েছে। ফলে ব্যাংকিং লেনদেনে অনেকটা স্বচ্ছতা আসার কথা। তবে বাস্তবে দেখা গেছে, প্রভাবশালীদের অর্থ পাচার নিয়ে এই ইউনিটের কাজের ক্ষমতা ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে এসেছে। ফলে তাদের কাজের পরিধি বাড়লেও দেশ থেকে অর্থ পাচার একই সঙ্গে বেড়েছে।
বিএফআইইউ একসময় শুধু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য নিতে পারত। এখন শেয়ারবাজারের ব্রোকারেজ হাউস, মার্চেন্ট ব্যাংক, বেসরকারি সংস্থা (এনজিও), বিমাপ্রতিষ্ঠান, জুয়েলারি দোকানসহ ১৭টি খাত থেকে তথ্য নিতে পারে। ফলে দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগসহ বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থার কাছে এই সংস্থার গোয়েন্দা প্রতিবেদন পাঠানোর হারও ক্রমেই বাড়ছে। তবে এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ও বড় অপরাধ নেই বললেই চলে।
পরিদর্শন কার্যক্রমে যুক্ত বিএফআইইউর এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিএফআইইউ মূলত পরিচালিত হয় সরকারি ও রাষ্ট্রীয় সংস্থার পরামর্শে। তাদের পরামর্শেই বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হিসাব তলব করা হয়। তাদের নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে বিভিন্ন সংস্থার কাছে পাঠানো হয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য।
‘বড়দের বিষয়ে এর বাইরে কাজের সুযোগ আমাদের নেই’ বলে জানান তিনি। অথচ বিএফআইইউয়ে প্রতিটি ব্যাংক ১০ লাখ টাকার বেশি লেনদেন ও সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য প্রতিদিন জমা দেয়।
একইভাবে আর্থিক লেনদেনের তথ্য দেয় ১৭টি খাতের প্রতিষ্ঠান। গত এক বছরে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো থেকে নামে-বেনামে যেভাবে টাকা বের করার তথ্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তা বিএফআইইউর অজানা নয়। তবে সংস্থাটি এখন পর্যন্ত এসব ব্যাংকে এ নিয়ে কোনো পরিদর্শন করেনি।
বিএফআইইউ স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হলেও এর রিপোর্টিং প্রধান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। ফলে পুরো বিষয়টি নিয়ে সবাই অবগত।
জানা যায়, ১৯৮৯ সালে জি-২০ দেশগুলো মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধের লক্ষ্যে ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স (এফএটিএফ) প্রতিষ্ঠা করে। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এফএটিএফের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নকারী সংস্থা এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানি লন্ডারিংয়ের (এপিজি) প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য বাংলাদেশ। এরপর ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা বিশ্বব্যাপী অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রেক্ষাপট পাল্টে দেয়।
বাংলাদেশ ২০০২ সালে অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইন প্রণয়ন করে। ওই বছরই মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগ নামে বাংলাদেশ ব্যাংক পৃথক একটি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে। এই বিভাগই পরবর্তী সময়ে বিএফআইইউ রূপান্তরিত হয়। বিএফআইইউ এখন সরকারের একটি স্বতন্ত্র সংস্থা হিসেবে অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন প্রতিরোধে কাজ করছে। গভর্নর যেমন এই ইউনিটের রিপোর্টিং প্রধান, তেমনই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারাই এই ইউনিট পরিচালনা করেন।
আর্থিক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কানাডা ও মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিদের তথাকথিত সেকেন্ড হোম তৈরি করা, সিঙ্গাপুরের তারকা হোটেলের মালিকানা নেওয়া ও সুইস ব্যাংকে অর্থ রাখা—এখন বহুল আলোচিত বিষয়। এ ছাড়া কয়েকটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও কয়েকজন ব্যবসায়ীর অর্থ পাচারের অভিযোগ ব্যাংকপাড়ায় মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। কিন্তু এসব বিষয়ে বিএফআইইউর কোনো তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে না। এ ধরনের নির্লিপ্ততার কারণে বিএফআইইউর কাজের পরিধি ও প্রতিবেদনের সংখ্যা বাড়লেও দেশ থেকে অর্থ পাচার রোধ হচ্ছে না।
বিএফআইইউর সাবেক ও বর্তমান একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, ১০ বছর আগেও যাঁদের নিয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদন করা যেত, এখন তা কল্পনাও করা যায় না। এ ক্ষেত্রে সরকারের দিক থেকে যেমন চাপ রয়েছে, তেমনি বিএফআইইউ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এগোতে চায় না। কারণ, এখানে নিয়োগ হয় সরকারের ইচ্ছাতেই। ফলে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়, এমন কোনো প্রতিবেদন এখন তৈরি করা হয় না। ফলে প্রশ্নের মুখে পড়েছে ইউনিটটির কার্যক্রম।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে বিএফআইইউর প্রধান মাসুদ বিশ্বাস বলেন, ‘গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ আইনত আমাদের নেই।’
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক একজন গভর্নর নাম প্রকাশ না শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, অর্থ পাচার ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট ছয়টি সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। এ ছাড়া অর্থ পাচার রোধ করা যাবে না। প্রথমত, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএফআইইউকে সক্রিয় হতে হবে। এর পাশাপাশি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ ও দুর্নীতি দমন কমিশনকে উদ্যোগী হতে হবে। সক্রিয় হতে হবে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসকেও।
তিনি আরও বলেন, অর্থ পাচারের সঙ্গে হুন্ডি সরাসরি জড়িত। তাই হুন্ডি কমাতে বৈধ চ্যানেলে অর্থ আনা আরও সহজ করতে হবে। কাস্টমসকে সক্রিয় হয়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম তদারক জোরদার করতে হবে। পাশাপাশি পাচারকারী কাউকে বড় শাস্তি দিতে হবে। তাহলে বন্ধ হবে অর্থ পাচার।