ঋণের জামানত প্রদান, ব্যক্তিগত গ্যারান্টি, করপোরেট গ্যারান্টিসহ সবই করেছেন আলী হায়দার রতন। পাশাপাশি ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের নামে ১৬ কোটি টাকা কর্মক্ষমতা গ্যারান্টি সুবিধা দিয়েছে এবি ব্যাংক।
এবি ব্যাংকের গুলশান শাখায় চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি ঋণের জন্য আবেদন করে কাগুজে কোম্পানি ব্র্যান্ডশেয়ার ট্রেডিং লিমিটেড। একই দিন শাখা ব্যবস্থাপক কোম্পানিটির অফিস পরিদর্শন করে জানান, ব্র্যান্ডশেয়ার ট্রেডিং বিদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে জ্বালানি ও নির্মাণসামগ্রী, রাসায়নিক পদার্থ ও খাদ্যপণ্য আমদানি করে থাকে। অথচ প্রতিষ্ঠানটি তখন পর্যন্ত কোনো ব্যবসাই শুরু করেনি। এর ভিত্তিতেই গত ৯ ফেব্রুয়ারি এবি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সাড়ে তিন শ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন দেয়।
বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এই ঋণ আটকে দিয়ে পরিদর্শন করে দেখেছে, এই ঋণের প্রকৃত সুবিধাভোগী আলী হায়দার রতন। তাঁর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের ভেতরেই নামমাত্র কোম্পানিটির কার্যালয়। এই ঋণের জামানত প্রদান, ব্যক্তিগত গ্যারান্টি, করপোরেট গ্যারান্টিসহ সবই করেছেন আলী হায়দার রতন। এর পাশাপাশি ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের নামে ১৬ কোটি টাকা কর্মক্ষমতা গ্যারান্টি সুবিধা দিয়েছে এবি ব্যাংক।
এর পরিপ্রেক্ষিতে এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে চিঠি দিয়েছে বিএফআইইউ। বিএফআইইউ বলেছে, ব্যাংকটিতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা প্রয়োজন। এবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও পরিচালনা পর্ষদ এবং আলী হায়দার রতন পরস্পর যোগসাজশে দুর্নীতি ও জালিয়াতির মাধ্যমে একটি কাগুজে ও বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে ৩৫০ কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর করা হয়েছে, যার প্রকৃত সুবিধাভোগী আলী হায়দার রতন।
তবে ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আলী হায়দার রতন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সহায়তার উদ্দেশ্যে আমি ব্র্যান্ডশেয়ারের জামানতদার হয়েছি। আমার অফিস তাদের ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছি। এর সঙ্গে আমার মালিকানার কোনো সম্পর্ক নেই। ইতিমধ্যে জামানত প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
দুদকে পাঠানো বিএফআইইউয়ের নথিপত্র অনুযায়ী, আমদানি, রপ্তানি ও সরবরাহকারী হিসেবে গত বছরের ৯ জুন যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তর (আরজেএসসি) থেকে নিবন্ধন নেয় ব্র্যান্ডশেয়ার ট্রেডিং লিমিটেড। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নেয় গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর। গত বছরের ৭ নভেম্বর ১০ হাজার টাকা জমা দিয়ে এবি ব্যাংকের গুলশান শাখায় কোম্পানিটির চলতি হিসাব খোলা হয়। এরপর গত ১০ জানুয়ারি ৩৫০ কোটি টাকা ঋণ চেয়ে আবেদন করে ব্র্যান্ডশেয়ার ট্রেডিং।
জানা গেছে, আবেদনের দিনই গুলশান শাখার ব্যবস্থাপকসহ তিনজন কর্মকর্তা প্রতিষ্ঠানটির ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারের ঠিকানা পরিদর্শন করে পরের দিন প্রধান কার্যালয়ে প্রতিবেদন জমা দেয়। এতে উল্লেখ করা হয়, ব্র্যান্ডশেয়ার ট্রেডিং বিদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে জ্বালানি ও নির্মাণসামগ্রী, রাসায়নিক পদার্থ ও খাদ্যপণ্য আমদানি করে থাকে। ব্যাংকের ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও ঋণ বিভাগ এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
৯ ফেব্রুয়ারি ৩৫০ কোটি টাকা ঋণ সুবিধা অনুমোদন করে ব্যাংক। এর মধ্যে ২৫০ কোটি টাকা ঋণপত্র খোলার সীমা ও ১০০ কোটি টাকা ব্যাংক গ্যারান্টি। আবার ২৫০ কোটি টাকা ঋণপত্র সীমার মধ্যে ১৫০ কোটি টাকা বিশ্বাসের ঋণ ও ১০০ কোটি টাকা মেয়াদি ঋণে রূপান্তর করা যাবে। অর্থাৎ ঋণপত্রের দায় শোধ না করলে সে ঋণ মেয়াদি ঋণে রূপান্তর করতে বাধা নেই।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংক থেকে টাকা নেওয়ার পর তা ফেরত দেওয়ার উদ্দেশ্য নেই। এ জন্য এসব ফাঁকফোকর রেখে পর্ষদ এই ঋণ অনুমোদন দিয়েছে।
নথিপত্র অনুযায়ী, ব্র্যান্ডশেয়ার ট্রেডিং কোম্পানির ৯০ শতাংশ শেয়ারের মালিক মোহাম্মদ আতাউর রহমান একজন ছাত্র ও ১০ শতাংশ শেয়ারের মালিক মামুনুর রশিদ বেসরকারি চাকরিজীবী। তবে এবি ব্যাংকে হিসাব খোলা এবং ঋণের আবেদনসংক্রান্ত সব তথ্য জমা দেন আলী হায়দার রতন।
নথিপত্র ব্র্যান্ডশেয়ারের ঠিকানা ও ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশন কোম্পানির ঠিকানাও একই। ব্র্যান্ডশেয়ার ট্রেডিং কোম্পানির ঋণের জন্য এবি ব্যাংকে যে জমি বন্ধক দেওয়া হয়, তা আলী হায়দার রতন ও তাঁর স্ত্রীর মালিকানাধীন টোটাল কেয়ার প্লাটিনাম লিমিটেডের। এই ঋণের জন্য করপোরেট গ্যারান্টি ও ব্যক্তিগত গ্যারান্টিও দেন আলী হায়দার রতন। যেসব জমি দেওয়া হয়, তার সরকারি মূল্য মাত্র ১১ কোটি টাকা। জমির মূল্য প্রায় ১৬ গুণ বেশি দেখিয়ে ঋণের আবেদন করা হয়। বিএফআইইউ বলেছে, এসব ঋণের প্রকৃত সুবিধাভোগী আলী হায়দার রতন।
এ বিষয়ে জানতে এবি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গেলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারিক আফজাল ব্যাংকটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদুল হাসানকে কথা বলার দায়িত্ব দেন। মাহমুদুল হাসান এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, যথাযথ নিয়ম মেনে ঋণটি অনুমোদন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত জামানত আছে। অন্য একটি প্রতিষ্ঠান করপোরেট গ্যারান্টিও দিয়েছে। ঋণ অনুমোদন হলেও কোনো সুবিধা এখন পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। তবে ঋণের সুবিধাভোগী কে, এ নিয়ে জানতে চাইলে তিনি উত্তর দেননি।
আলী হায়দার রতন হলেন একজন ঠিকাদার। ১০ বছর ধরে দেশের সরকারি বিভিন্ন কাজ তিনি একক ও যৌথভাবে করছেন। সাম্প্রতিক সময় তিনি আলোচনায় আসেন ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে রাত আটটার পর সাড়ে ২২ কোটির বেশি টাকা উত্তোলনের কারণে। যদিও ব্যাংকিং লেনদেনের সময়সূচি সকাল ১০টা থেকে বেলা সাড়ে ৩টা পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়া ও উত্তোলন করা যায়।
জানা যায়, গত ২৮ ডিসেম্বর রাত আটটার পর তাঁকে ন্যাশনাল ব্যাংকের গুলশান করপোরেট শাখা থেকে ৭ কোটি ৬০ লাখ, গুলশান শাখা থেকে ৫ কোটি ও বনানী শাখা থেকে ১০ কোটি টাকা উত্তোলনের সুযোগ দেওয়া হয়। বিষয়টি ব্যাংকের পক্ষে তদারক করেন ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ রইস উদ্দিন। তিনিসহ সংশ্লিষ্ট শাখার ব্যবস্থাপক, ব্যাংকের সচিব, ঋণ ঝুঁকি বিভাগের প্রধানের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়েছে বিএফআইইউ। এ জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ব্যাংক খাত সূত্রে জানা যায়, আলী হায়দার রতনের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণ রয়েছে প্রায় ৫২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকে ঋণ রয়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকে ১৮০ কোটি, জনতা ব্যাংকে ৭০ কোটি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে ৪০ কোটি ও বেসিক ব্যাংকে ৩৫ কোটি টাকা।
ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে রাতে টাকা তোলার ঘটনা নিয়ে আলী হায়দার রতন বলেন, ‘বছরের শেষ সময় হওয়ায় বেতন-ভাতা দেওয়া ও বিল পরিশোধের তাড়া ছিল। আমি দিনে চেক জমা দিয়েছি। চারটি শাখা থেকে টাকা জোগাড় করেছে ব্যাংক, এ জন্য সময় লেগে গেছে। এতে তো আমার কোনো দোষ নেই। ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার জন্য আমি সবার সহযোগিতা চাই।’
ব্যাংক কর্মকর্তাদের আরও বেশি সতর্ক হতে হবে। কারণ, দিন শেষে ব্যাংক কর্মকর্তাদেরকে শাস্তির মুখে পড়তে হয়। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে, তাহলে অন্য ব্যাংকগুলো সতর্ক হবে।হেলাল আহমেদ চৌধুরী, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পূবালী ব্যাংক
ব্র্যান্ডশেয়ার ট্রেডিংকে অনুমোদন করা ঋণের বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে বলেছে বিএফআইইউ। তারা এ ক্ষেত্রে এবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও পরিচালনা পর্ষদের দায় দেখছে। পূবালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেলাল আহমেদ চৌধুরীও মনে করেন, ব্যাংক কর্মকর্তাদের অগোচরে এ রকম বেনামি ঋণ ও অনিয়ম হওয়া সম্ভব নয়, তবে মালিকপক্ষের স্বার্থের বিষয়টিও খতিয়ে দেখা দরকার।
প্রথম আলোকে হেলাল আহমেদ চৌধুরী বলেন, ব্যাংক কর্মকর্তাদের আরও বেশি সতর্ক হতে হবে। কারণ, দিন শেষে ব্যাংক কর্মকর্তাদেরকে শাস্তির মুখে পড়তে হয়। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে, তাহলে অন্য ব্যাংকগুলো সতর্ক হবে। আর অনিয়মের মাধ্যমে যেসব ঋণ অনুমোদন হয়, দেখা গেছে তার বড় অংশই খেলাপি হয়ে পড়ে।