দুর্বল ও সমস্যাযুক্ত ব্যাংকগুলোকে টাকা ছাপিয়ে আর সহায়তা দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, হঠাৎ করে ব্যাংক বন্ধ করে কিংবা ব্যাংকের জন্য টাকা ছাপিয়ে কোনো সমাধানের পথে যাওয়া যাবে না।
আজ মঙ্গলবার রাজধানীর মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানানোর সময় গভর্নর এসব কথা বলেন।
গভর্নর জানান, এক হাজার টাকার নোট বাতিলের কোনো পরিকল্পনা তাঁদের নেই। ফলে এটা নিয়ে যেন গুজব ছড়ানো না হয়। তবে দুর্বল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভাঙার বিষয়টি তাঁদের বিবেচনায় রয়েছে।
শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর দুর্বল পরিস্থিতি ও চলমান অস্থিরতা নিয়ে গভর্নর আহসান এইচ মনসুরকে প্রশ্ন করেন সাংবাদিকেরা। এসব ব্যাংকের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কী ভাবছে, তা জানতে চান তাঁরা। জবাবে গভর্নর বলেন, এত দিন যা হওয়ার, তা হয়েছে। এখন ওই ব্যাংকগুলোকে উদ্ধারের প্রক্রিয়া আলাদা হবে। তবে ব্যাংকগুলো থেকে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা যেন আর টাকা সরাতে না পারেন, সেই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ব্যাংকিং কমিশন গঠন হলে দুর্বল ব্যাংকগুলোর সংখ্যা কমিয়ে বা তাদের একীভূত করে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। কিন্তু ব্যাংক বন্ধ বা টাকা ছাপিয়ে তা সমাধান করা হবে না।
শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো থেকে গ্রাহকেরা আমানত তুলে নিচ্ছেন, জানিয়ে গভর্নরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সাংবাদিকেরা। এ প্রসঙ্গে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমানত তুলে নেওয়া আমানতকারীর সার্বভৌম অধিকার। আমানতকারীরা নিরাপদ বোধ না করলে তাঁরা টাকা তুলে নেবেন। সরকার সেখানে হস্তক্ষেপ করবে না। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনার ওপর আমানতকারীদের আস্থা না থাকলে সেই ব্যাংক চলতে পারে না। সব সময় এমন ব্যাংককে উদ্ধার করতে যাওয়া ঠিক নয়। এই পরিস্থিতির জন্য ওই ব্যাংক কর্তৃপক্ষই দায়ী; তারা নিজ দায়িত্বে এ অবস্থায় নিয়ে গেছে। ফলে আমরা তাদের এখন কোনো সহায়তা দেব না।’
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলমের নেতৃত্বাধীন ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদলে ছিলেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু, নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান টি রহমান, ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ, বস্ত্রকলের মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল প্রমুখ।
প্রতিষ্ঠানকে নয়, দোষী ব্যক্তিদের ধরা হবে
বৈঠকে ব্যবসায়ীরা ব্যাংকিং খাত নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বলে সাংবাদিকদের জানান গভর্নর। তিনি বলেন, ‘ইসলামি ব্যাংকগুলোর বিষয়ে সরকারের অবস্থানও জানতে চেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তবে এ বিষয়ে যেন সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়, এ জন্য আমরা (বাংলাদেশ ব্যাংক) একটু সময় নিচ্ছি। তাড়াহুড়ো করে জনপ্রিয় হওয়ার মতো কিছু করছি না।’
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমরা যেটাই করি না কেন, যাঁরা দোষী, তাঁদের ধরা হবে। কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে লক্ষ্যবস্তু বানানো হবে না। এটার নিশ্চয়তা আমরা ব্যবসায়ীদের দিয়েছি। কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা দায়ী থাকলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাও দায়ী থাকলে দেখা হবে।’
দুই-এক সপ্তাহের মধ্যে ব্যাংকিং কমিশন গঠনের ঘোষণা আসবে বলে জানান গভর্নর। তিনি বলেন, ‘দুর্বল ব্যাংকগুলোর সমস্যার টেকসই সমাধানের জন্য আমরা কাজ করছি। ব্যাংকে ঘটা ঘটনাগুলো কাদের দ্বারা হয়েছে, কত পরিমাণে হয়েছে; সেগুলো হিসাব না করে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। হয়তো দুই-এক সপ্তাহের মধ্যেই আমরা একটা ঘোষণাতে যেতে পারব। তারপর এর কর্মপরিধি ঠিক করে প্রতিটি দুর্বল ও সমস্যাযুক্ত ব্যাংককে চিহ্নিত করে আলাদাভাবে এগোনো হবে। শুরুতে বড় ব্যাংকগুলো নিয়ে কাজ করা হবে। কারণ, তারাই পদ্ধতিগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংক। বর্তমানে যেহেতু অস্থিরতা চলছে, ফলে যে সমাধানই নিই না কেন, সেটা বিতর্ক ছাড়া হবে না।’
মূল্যস্ফীতি কমে আসবে
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর জানান, ব্যবসায়ীরা মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার জন্য তাগাদা দিয়েছেন। এর জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের আশ্বস্ত করেছে। তিনি বলেন, বর্তমান মুদ্রানীতি ঠিকভাবে কাজ করছে। এটি আরও কিছুটা সংকোচন করা হবে; তবে খুব বেশি নয়। যথাযথভাবে চললে সাত থেকে আট মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি ভালো অবস্থায় আসবে। তখন এটি ৫-৬ শতাংশে নেমে আসবে বলে আশা করা যায়।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করার আগপর্যন্ত সুদহার বাড়িয়ে যেতে হবে। আমরা এ নীতিতে রয়েছি। পাশাপাশি বর্তমানে মুদ্রার বিনিময় হার যেহেতু মোটামুটি স্থিতিশীল রয়েছে, তাই এটিও মূল্যস্ফীতি কমাতে সহায়ক হবে।
সভায় ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন যে তাঁরা ব্যাংক থেকে টাকার জোগান কম পাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে আহসান এইচ মনসুর সাংবাদিকদের বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে টাকা ছাপিয়ে এ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। এটা করতে হবে আমানত সংগ্রহের মাধ্যমে। ব্যাংকে তারল্য ও বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়িয়ে তা দিয়ে আমানতের প্রবৃদ্ধি বাড়ানো গেলে ঋণের সরবরাহও বাড়বে। পাশাপাশি সরকার বাজেটের জন্য যে বিপুল অর্থ ব্যাংক থেকে নেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিল, তা-ও কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে জানান তিনি।
ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে বর্তমানে কিস্তি দেওয়ার তারিখের ১৮০ দিন পার হওয়ার পর খেলাপি ধরা হয়। এই সময় ৯০ দিনে নামিয়ে আনার চেষ্টা চলছে বলে জানান গভর্নর। তিনি বলেন, এটিই আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড। তবে এটি ৯০ দিনে কমিয়ে আনার বিষয়ে ব্যবসায়ীরা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে এ নিয়ম বাস্তবায়িত হলে খেলাপি ঋণ অনেক বেড়ে যাবে এবং অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
এ বিষয়ে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমরা এটা দেখব। এ বিষয়ে আইএমএফের সঙ্গেও আলোচনা করে আস্তে আস্তে সবার জন্য গ্রহণযোগ্য একটা সিদ্ধান্ত নেব। তবে তিন মাস সময় লাগলেও আমরা অবশ্যই আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ডে যাব।’