কলমানির সুদের হার ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে। সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে গতকাল বৃহস্পতিবার কল মানিতে এক দিনের জন্য টাকা কর্জ বা ধার দেওয়ার ক্ষেত্রে গড় সুদের হার ৯ দশমিক ১৪ শতাংশে উঠেছে। ২০১২ সালের পর এটিই কল মানির সর্বোচ্চ সুদহার। ওই বছর ১২ দশমিক ৮২ শতাংশে উঠেছিল সুদহার।
হঠাৎ কল মানির সুদহার বেড়ে যাওয়া সম্পর্কে ব্যাংকাররা বলছেন, বেশ কিছু ব্যাংক বর্তমানে তারল্য-সংকটে ভুগছে। এ কারণে সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে অন্য ব্যাংক থেকে কল মানি (ধার বা কর্জ) নিতে হয়েছে। তাতে নগদ টাকার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সুদহার বেড়েছে।
এখন বছরের শেষ। তাই ব্যাংকগুলোকে তাদের স্থিতিপত্রের হিসাব-নিকাশ চূড়ান্ত করতে হবে। তাতে সব ব্যাংকেরই টাকার চাহিদা তৈরি হয়েছে। আবার কিছু ব্যাংকে তারল্য-সংকট রয়েছে।সৈয়দ মাহবুবুর রহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক
কল মানি হচ্ছে এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকের টাকা ধার নেওয়ার একটি ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় দৈনন্দিন ও স্বল্প মেয়াদে টাকার চাহিদা মেটাতে এক ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে টাকা ধার করে। যেসব ব্যাংকের কাছে অতিরিক্ত তারল্য থাকে, তারাই মূলত ধার দিয়ে এর বিনিময়ে সুদ নেয়। সুদের হার নির্ভর করে কত দিনের জন্য টাকা ধার নেওয়া হচ্ছে, তার ওপর। আবার কখনো কখনো চাহিদা ও সরবরাহের ওপর নির্ভর করেও সুদহার ওঠানামা করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকিতে কল মানি দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, কল মানিতে এক দিন থেকে শুরু করে ১৮২ দিনের জন্যও টাকা ধার নেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ৩০ দিনের বেশি সময়ের জন্য যে ধার দেওয়া হয়, সেটাকে মেয়াদি ধার বলা হয়। আর ১ থেকে ১৪ দিনের জন্য যে অর্থ ধার করা হয়, সেটাকে বলা হয় স্বল্পমেয়াদি ধার। ব্যাংকগুলো এখন স্বল্পমেয়াদি ধারই বেশি করছে কল মানিতে। বিভিন্ন ব্যাংক গতকাল স্বল্প ও মেয়াদি মিলিয়ে কল মানিতে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা নিয়েছে। যত বেশি দিনের জন্য ধার, সুদহার তত বেশি হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গতকালের ৪ হাজার কোটি টাকার কল মানির মধ্যে ২ হাজার ৮৯১ কোটি টাকাই নেওয়া হয়েছে এক দিনের জন্য। এই ধারের গড় সুদহার ছিল ৯ দশমিক ১৪ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪৫০ কোটি টাকার ধার ছিল পাঁচ দিনের জন্য, এর গড় সুদহার ১০ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
চলতি বছরের শুরু থেকে কল মানিতে টাকা ধারের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। তাতে বছরের শুরু থেকে একটু একটু করে সুদহারও বাড়তে থাকে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে গড় সুদহার ছিল ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ, যা নভেম্বরের মাঝামাঝি ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। আর ডিসেম্বরে এসে আরেক দফা বেড়ে ৯ শতাংশে ওঠে।
বছরের শুরু থেকে বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। তাতে নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে গেছে। এ কারণে একদিকে কমেছে সঞ্চয়, অন্যদিকে অনেকে সঞ্চয় ভাঙাচ্ছেন। তাতে ব্যাংকে নতুন আমানত আসা কমেছে। এর ফলে ব্যাংক খাতে তারল্য-সংকট দেখা দেয়। এ সংকটকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে শরিয়াহভিত্তিক কিছু ব্যাংকের ঋণসংক্রান্ত অনিয়ম। এসব ব্যাংকের সংকট পুরো খাতে প্রভাব ফেলেছে।
এ ছাড়া সরকারি ট্রেজারি বিলের সুদহারও বেড়েছে। যেসব ব্যাংকের হাতে অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে, তারা বেশি সুদের জন্য ট্রেজারি বিলে অর্থ লগ্নি করছে। ফলে বাজারে ধার দেওয়ার মতো অতিরিক্ত তারল্য কমেছে। এদিকে কিছু ব্যাংককে ধার করে দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। তাতেই বেড়েছে কল মানির সুদহার।
ব্যাংকাররা বলছেন, বছরের শেষ সময়ে এসে ব্যাংকগুলোকে তাদের স্থিতিপত্র বা ব্যালেন্সশিট চূড়ান্ত করতে হয়। এতে সব ব্যাংকেরই নগদ অর্থের চাহিদা বেড়ে যায়। এ কারণে বছরের শেষ সময়ে এসে কল মানিতে সুদহার বেড়েছে।
এ বিষয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এখন বছরের শেষ। তাই ব্যাংকগুলোকে তাদের স্থিতিপত্রের হিসাব-নিকাশ চূড়ান্ত করতে হবে। তাতে সব ব্যাংকেরই টাকার চাহিদা তৈরি হয়েছে। আবার কিছু ব্যাংকে তারল্য-সংকট রয়েছে। এসব কারণে এ সময়ে কল মানিতে নগদ টাকার চাহিদা বেড়ে গেছে।
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান আরও বলেন, বর্তমানে ব্যাংকে গ্রাহকের মেয়াদি আমানত আসা আগের চেয়ে কমেছে। আবার জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় অনেকে সঞ্চয় ভেঙে ফেলছেন। তাতে কিছু ব্যাংক তারল্য-সংকটে পড়েছে। সব মিলিয়ে বছরের শেষ দিকে এসে টাকার চাহিদা বেড়ে গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যাংকার জানান, নির্বাচন সামনে রেখে বাজারে নগদ টাকার চাহিদা অনেক বেড়েছে। এ কারণে টাকা তোলার প্রবণতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রাহকের তাৎক্ষণিক এই চাহিদা মেটাতে ব্যাংকগুলো এক দিনের জন্য বেশি টাকা ধার করেছে।