অস্ত্রের জোরে ব্যাংক দখলের পথ দেখিয়েছিলেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। পরে রাষ্ট্রীয় মদদে কৌশল বদল করে ব্যাংক দখল করেছিলেন এস আলম ও তাঁর সঙ্গীরা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ব্যাংক দখলের ফলে পুরো ব্যাংক খাতে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।
ব্যাংক কীভাবে দখল করতে হয়, সেটা প্রথমে শিখিয়েছিলেন আওয়ামী লীগেরই সাবেক শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদক আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। তিনি অস্ত্রের মুখে বেসরকারি খাতের ইউসিবিএল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ দখল করেছিলেন। তখন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন আওয়ামী লীগেরই আরেক নেতা জাফর আহমেদ চৌধুরী। দুজনেরই রাজনীতির জায়গা ছিল চট্টগ্রাম। এই দখলের সঙ্গে সরকার বদলের কোনো বিষয় ছিল না, বরং অস্ত্রের জোরে নিজের আধিপত্য বজায় রাখাই ছিল উদ্দেশ্য।
তখন আমি নিজেও সাংবাদিকতা করি। দখলের পর থেকে পুরো ঘটনার রিপোর্ট আমাকে করতে হয়েছিল। ঘটনাটি ছিল ১৯৯৯ সালের ২৬ আগস্ট। মতিঝিলে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে হামলার পরে ঘটনার বিবরণ দিয়ে ব্যাংকের পক্ষ থেকে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। সেখানে বলা ছিল, ‘ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গতকাল নির্ধারিত বোর্ড মিটিং ছিল। বোর্ড মিটিং চলাকালে আনুমানিক বেলা সাড়ে তিনটায় আখতারুজ্জামান বাবু ও তাঁর ছেলে জাভেদসহ ৫০-৬০ জনের অস্ত্রধারী ক্যাডার বোর্ডরুমে অতর্কিতভাবে হামলা চালান, পরিচালকদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও মারধর করেন এবং মারমুখী অবস্থায় জোরপূর্বক প্রত্যেক পরিচালকের কাছ থেকে টাইপ করা কাগজে স্বাক্ষর আদায় করেন, পরিচালকদের পদত্যাগে বাধ্য করেন। অস্ত্রধারীরা ব্যাংকের চেয়ারম্যান জাফর আহমেদ চৌধুরীকে নির্মমভাবে প্রহার ও বিবস্ত্র করে ফেলেন। ঘটনাস্থলে পুলিশের উপস্থিতি সত্ত্বেও তাদের কাছ থেকে কোনো সাহায্য পাওয়া যায়নি। পরবর্তী সময়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ঘটনাটি জানানো হলে অতিরিক্ত পুলিশ ফোর্স ঘটনাস্থলে প্রেরণ করা হয়। পুলিশ পরিচালকদের বোর্ডরুম থেকে বের করার ব্যবস্থা নেয়, তা না হলে উপস্থিত পরিচালকেরা কোনোভাবেই ঘটনাস্থল থেকে বের হতে
পারতেন না।’
ব্যাংকের শেয়ারধারী হলেও আখতারুজ্জামান চৌধুরী ছিলেন ২২০ কোটি টাকার ঋণখেলাপি। এ নিয়ে মামলা করার পরেই হামলার ঘটনা ঘটেছিল। দখল করে তিনি নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করে বিজ্ঞপ্তিও পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আর একই দিনে জাফর আহমেদ চৌধুরী সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, হামলাকারীর দলে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর পুত্র জাভেদ (পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের ভূমি প্রতিমন্ত্রী, যাঁর বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগে তদন্ত চলছে) ছাড়াও ছিলেন চট্টগ্রাম কমার্স কলেজের কাদেরীয়া বাহিনীর কাদের, নাসিরাবাদের ছিড়া আকবর ও বাঁশখালীর খুরশীদ।
পুরোনো আরেকটি ঘটনার কথা এখানে বলা প্রয়োজন। ১৯৯৩ সালের ৮ এপ্রিল ইউসিবিএলেরই পরিচালক হুমায়ুন জহিরকে ধানমন্ডির বাসায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। বলা হয় ব্যাংক পরিচালকদের মধ্যে বিরোধের কারণেই এই হত্যাকাণ্ড। এ ঘটনায় আখতারুজ্জামান বাবুকে দায়ী করে মামলা ও তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। জামিন পেয়ে পরে তিনি দেশ ছেড়ে চলে যান, ফিরে আসেন ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরে। তারপরই ব্যাংক দখলের এই ঘটনা।
জাফর আহমেদ চৌধুরী ও আখতারুজ্জামান বাবু—দুজনই দলের সদস্য হওয়ায় বিপাকে পড়ে গিয়েছিল সে সময়কার আওয়ামী লীগ সরকার। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া পরদিন মন্তব্য করেছিলেন, ‘ইউসিবিএল ঘটনার দুটি দিক আছে। একটি অর্থনৈতিক, যা বাংলাদেশ ব্যাংক দেখছে। অন্যটি রাজনৈতিক, যা প্রধানমন্ত্রী দেখবেন।’ ফলে কাকে রেখে কাকে বাদ দেওয়া হবে, এ নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যায় সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক উভয় পক্ষকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়, বোর্ডের কার্যক্রম বন্ধ করে। পরে আদালতের আদেশে চেয়ারম্যান পদ ফিরে পেয়েছিলেন জাফর আহমেদ চোধুরী। নানা অনিয়মের কারণে শেষ পর্যন্ত তাঁকেও চলে যেতে হয় ব্যাংক ছেড়ে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আখতারুজ্জামান বাবু আবার ইউসিবিএলের চেয়ারম্যান হন। সেই থেকে এই ব্যাংক তাঁর পরিবারের দখলেই আছে। সুতরাং সোশ্যাল মিডিয়ার জনপ্রিয় চরিত্র ‘বাবু’ কী কী খেয়েছে জানি না, তবে ব্যাংক যে ‘খেয়েছিল’ তা পরিষ্কার।
সময় পাল্টে গেছে। এখন আর ব্যাংক দখল করতে বন্দুকের প্রয়োজন হয় না। অস্ত্র হাতে ব্যাংক ডাকাতি বিশ্বে এখনো হয়। যদিও গবেষকেরা বলছেন, এভাবে ব্যাংক ডাকাতি আর আগের মতো খুব একটা কার্যকর হয় না। বরং তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে ব্যাংক ডাকাতির নতুন নতুন পথ বের হচ্ছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিজার্ভ চুরি করে এ বিষয়ে পথ দেখিয়ে দিয়েছে সাইবার অপরাধীরা।
এ যুগে ব্যাংক ডাকাতেরা এখন দুই ধরনের। এক দল আছে যাদের লক্ষ্য হচ্ছে ব্যাংকের কোনো এক শাখা থেকে অর্থ লুট করা। একদল ডাকাত তো এখনো সুড়ঙ্গ খুঁড়ে ব্যাংক থেকে অর্থ লুট করে। আরেক দল আছে সুড়ঙ্গের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে নয়, বরং ক্ষমতাসীনদের কাছে হামাগুড়ি দিয়ে যায় ব্যাংক ডাকাতির অনুমোদন নিতে। এখানে পুরোনো কৌতুকটাই আবার বলা যেতে পারে।
অনেক দিন আগের কথা, ডাকাতেরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ব্যাংক ডাকাতি করত। তাতে ডাকাতদের খুব কষ্ট হতো। এরপর তারা সবাই মিলে একটা বুদ্ধি করে নিজেরাই একটা ব্যাংক তৈরি করে ফেলল। তারপর সব মানুষ সেই ব্যাংকে টাকা রাখতে এল। আর ডাকাতেরা ব্যাংকে বসেই তাদের ডাকাতি চালাতে থাকল।
বাংলাদেশ অবশ্য আরেক ধাপ এগিয়ে। এখানে ডাকাতেরা নিজেরা ব্যাংক তৈরি করে ডাকাতি করে না, বরং অন্যের ব্যাংক দখল করে তবেই ডাকাতি শুরু করে। ইউসিবিএল ব্যাংকে আখতারুজ্জামান বাবুর বিনিয়োগ ছিল। কিন্তু ‘মাসুদ’ যেহেতু ‘ভালো’ হয়ে যায় না, তাই তারা অন্যের ব্যাংক দখলেই বেশি আগ্রহী হয়। আর তাতে যদি রাষ্ট্রের সক্রিয় সহযোগিতা থাকে, তাহলে তো কথাই নেই।
সাইফুল আলম (এস আলম) ওরফে মাসুদের ইসলামী ব্যাংক দখল ব্যাংকিং জগতের কলঙ্কজনক অধ্যায়ের একটি। এই ব্যাংকটি দখল হয়েছিল ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি, খুবই ‘শান্তিপূর্ণ’ উপায়ে। এ নিয়ে পরদিন গণমাধ্যমে খুবই নিরীহ একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে বলা ছিল, ‘ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), নির্বাহী ও অডিট কমিটির চেয়ারম্যান পদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে জামায়াত-নিয়ন্ত্রিত ব্যাংক হিসেবেই পরিচিত ছিল। সেই পরিচয় থেকে ব্যাংকটিকে বের করে আনতে বেশ কিছুদিন ধরে এটির মালিকানা, পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় ধাপে ধাপে পরিবর্তন আসছিল। সর্বশেষ গতকাল দিনভর অনুষ্ঠিত পরিচালনা পর্ষদের সভায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়। রাজধানীর পাঁচ তারকা র্যাডিসন হোটেলে অনুষ্ঠিত পর্ষদ সভায় ব্যাংকটিতে বড় ধরনের এ পরিবর্তন আনা হয়।’
আসলে পুরো কাজটিই হয়েছিল সরকারের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায়। সরকারেরই একটি বিশেষ সংস্থা পুরো কাজটি তত্ত্বাবধান করেছিল। কাউকে কাউকে উঠিয়ে এনে জোরপূর্বক নথিতে সই করিয়ে ব্যাংকের মালিকানা হস্তান্তরের কাজটি তাঁরাই করে দিয়েছিলেন। অবশ্যই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমেই কাজটি হয়েছিল। এই দখল নিয়ে কেউ যাতে প্রকৃত ঘটনা নিয়ে লেখালেখি না করতে পারে, তা নিয়েও সরকারের নানা সংস্থার কড়া নজরদারি ছিল সে সময়।
আখতারুজ্জামান অস্ত্রের জোরে ব্যাংক দখল করতে চেয়েছিলেন। সেই ঘটনায় উৎসাহ পেয়ে অন্য কেউ আর এ পথে এগোয়নি। কিন্তু এস আলম যে উপায়ে ব্যাংক দখল করেছিলেন, তার কুপ্রভাব অপরিসীম। বলা যায় আধুনিক পদ্ধতিতে ব্যাংক দখলের পথিকৃৎ তিনি। ব্যাংক দখলের নতুন পদ্ধতি সেই থেকে শুরু। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আখতারুজ্জামান চৌধুরী ও এস আলম সম্পর্কে মামা–ভাগনে।
চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী এস আলম ব্যাংক খাতে ঢুকেছিলেন কমার্স ব্যাংকের শেয়ারের মালিক হয়ে, ২০১৫ সালে। ইসলামী ব্যাংকের পরে ২০১৭ সালের নভেম্বরেই সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের (এসআইবিএল) মালিকানায়ও বদল ঘটে। তবে সেবার র্যাডিসন ব্লু হোটেলের পরিবর্তে মালিকানা পরিবর্তনের ঘটনাটি ঘটেছিল আরেক পাঁচ তারকা হোটেল ওয়েস্টিনে, বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থার মধ্যে। দুই বৈঠকেই এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম উপস্থিত ছিলেন। ব্যাংক দখলের জন্য তাঁদের তাড়াহুড়া এতটাই ছিল যে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ফজলে কবির নতুন পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের ফাইলে স্বাক্ষর করতে রাত ১০টা পর্যন্ত অফিস করেছিলেন। এভাবে এক এক করে এস আলম গ্রুপের মালিকানায় এসেছিল সাতটি ব্যাংক।
‘গুরু’ থাকলে, গুরু মারা ‘শিষ্যেরও’ দেখা মেলে। এস আলমের সেই শিষ্য ছিলেন বহুল আলোচিত প্রশান্ত কুমার বা পি কে হালদার। এখন তিনি পশ্চিমবঙ্গে জেলে আছেন। পি কে হালদার একসময় এস আলম গ্রুপের মালিকানায় থাকা এনআরবি গ্লোবালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন। এস আলমের ব্যাংক দখলের একটা সহজ পাঠ আছে। আইন অনুযায়ী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হতে বাধ্য। তাদের শেয়ারবাজারে নিয়মিত লেনদেন হয়। কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কমপক্ষে ২ শতাংশ থাকলে পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হওয়া যায়। সেই শেয়ার কিনেই মূলত দখলের কাজটি করা হয়। এভাবেই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছিলেন এস আলম, পি কে হালদারেরা। এ জন্য অবশ্যই শেয়ারবাজার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তার প্রয়োজন ছিল, যা তাঁরা পেয়েছিলেন। যেমন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী ও নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম এসব কাজে সহায়তা করতেন। আর পরে তো আব্দুর রউফ তালুকদার ছিলেন মূলত এস আলমেরই গভর্নর। রাষ্ট্রীয় সহযোগিতায় দখল করে পদ্মা ব্যাংকের মালিক হয়েছিলেন আরেক সরকার–ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী চৌধুরী নাফিজ সরাফাত।
অর্থনীতিতে রাজনীতি ঢোকার বিপদ অনেক। তাতে সরকার বদল হলে সব পাশার দানই উল্টে যায়। আর নেতা পালিয়ে গেলে শিষ্যদেরই বিপদ বেশি হয়। তবে সবচেয়ে বিপদে পড়ে অর্থনীতি ও সামগ্রিক ব্যাংক খাত। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ব্যাংক দখলের ফলে পুরো ব্যাংক খাতে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এখান থেকে উদ্ধার পাওয়া সহজ হবে না। তবে এ থেকে অন্যরা শিক্ষা নেবেন, সে আশা তো করাই যায়। সাধুর সঙ্গে চলতি ভাষার মিশ্রণ কাম্য নয়, তবে অর্থনীতির সঙ্গে রাজনীতির মিশ্রণ সবচেয়ে ক্ষতিকর। এই শিক্ষাটাও সবাই গ্রহণ করুক।