ডলার-সংকট ও তহবিল দিতে বিদেশি ব্যাংকগুলোর অনীহার কারণে ব্যবসাটা থমকে গেছে। তবে কিছু ব্যাংকের ঋণে প্রবৃদ্ধি হওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে।
ঋণের সুদ কম হওয়ায় ও ডলার সরবরাহ ভালো থাকায় দুই বছর আগে পর্যন্ত দেশে অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের মাধ্যমে ব্যবসায়ে নজর বাড়িয়েছিল ব্যাংকগুলো। তখন এ নিয়ে তেমন কোনো আইনকানুন বা নীতিমালাও ছিল না। মূল ব্যাংকের দেওয়া অর্থেই পরিচালিত হতো অফশোর ইউনিটগুলো। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতেও অফশোর ইউনিটের মাধ্যমে অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটতে থাকে।
বর্তমানে ডলার-সংকট ও বিদেশি ব্যাংকগুলোর তহবিল দিতে অনীহার কারণে ব্যাংকগুলোর অফশোর ইউনিটের ব্যবসা অনেকটা থমকে গেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু ব্যাংকের অফশোর ইউনিটের ঋণ বিতরণে বড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে। সেই সঙ্গে বেড়ে গেছে খেলাপির পরিমাণও, যা নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে।
অফশোর ব্যাংকিং হলো ব্যাংকের অভ্যন্তরে পৃথক এক ব্যাংকিং ব্যবস্থা। বিদেশি কোম্পানিকে ঋণ প্রদান এবং বিদেশি উৎস থেকে আমানত সংগ্রহের মাধ্যমে ব্যবসা হয় অফশোর ব্যাংকিংয়ে। অফশোর ইউনিটের ব্যবসায়ের পুরোটাই হয়ে থাকে বৈদেশিক মুদ্রায়। ব্যাংকের প্রচলিত কোনো নিয়ম বা নীতিমালা অফশোর ব্যাংকিংয়ে প্রয়োগ হয় না। কেবল মুনাফা ও লোকসানের হিসাব যোগ হয় ব্যাংকের মূল হিসাবে।
জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘একসময় অফশোর ব্যাংকিংয়ে ভালো ব্যবসা হতো। বৈদেশিক লেনদেনের অনেক সেবা দেওয়ার সুযোগ থাকায় ডলারের খরচও কম হতো। ডলার-সংকটের কারণে ব্যবসাটা এখন আগের মতো নেই। আমাদের ঋণও কমে এসেছে। বিশ্বব্যাপী অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটছে বলে আলোচনা আছে। এ নিয়ে বাংলাদেশেও ভালো তদারকি হওয়া প্রয়োজন। নজরদারি বাড়ালে এ ব্যবসার মাধ্যমে অর্থ পাচার কমবে।’
জানা গেছে, ২০২১ সালের জুনে ব্যাংকগুলোর অফশোর ইউনিটের দেওয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৩ হাজার ৩৮৭ কোটি টাকা। তখন খেলাপি ছিল মাত্র ১ হাজার ৪০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১ শতাংশের কিছুটা বেশি। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে অফশোর ইউনিটগুলোর ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ৮৩ হাজার ৮২৬ কোটি টাকা। আর খেলাপি ঋণ বেড়ে ১ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকায় ওঠে, যা মোট ঋণের ২ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। আবার অফশোর ইউনিটের ঋণের ২২ শতাংশই সংকটে থাকা ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের।
অফশোর ইউনিটের ব্যবসা বিদেশি আমানত ও তহবিলে চলার কথা থাকলেও এখন ব্যাংকগুলোর নিজেদের তহবিলে তা পরিচালিত হচ্ছে। বিশেষ করে ডলার-সংকট শুরুর সময় অর্থ ফেরত না পাওয়ায় অনেক বিদেশি ব্যাংক তাদের তহবিল ফেরত নিয়ে যায়, যা আর ফিরে আসেনি। এ জন্য ২০২২ সালে ডলার-সংকট শুরুর পর ব্যাংকগুলোকে তার নিয়ন্ত্রণমূলক মূলধনের ৩০ শতাংশ পর্যন্ত অফশোর ইউনিটে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়। আগে যা ছিল ২০ শতাংশ।
অভিযোগ আছে, এখন কিছু ব্যাংকের মালিক অর্থ পাচারের জন্য অফশোর ইউনিটকে বেছে নিচ্ছেন। ফলে মূল ব্যাংকের পুরো অর্থ চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে শূন্যে নামিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি নতুন করে কোনো তহবিল অফশোর ইউনিটে না দেওয়ার জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এদিকে বিদেশি ব্যাংকগুলো যাতে অফশোর ইউনিটে তাদের তহবিল রাখে, এ জন্য সুদহার বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি এসব বিনিয়োগের ওপর কর উঠিয়ে নেওয়ারও পরিকল্পনা করছে সরকার। ফলে অফশোর ইউনিটের এক বছর পর্যন্ত ঋণে সুদহার দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯ শতাংশ। আর আমানতের সুদহার বেড়ে হয়েছে ৭-৯ শতাংশ পর্যন্ত।
দেখা গেছে, ২০২১ সালে ইসলামী ব্যাংকের অফশোর ইউনিটে ঋণ ছিল ৫ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা, যা ২০২২ সালে আড়াই গুণ বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা। আর গত বছরের সেপ্টেম্বরে ব্যাংকটির অফশোর ইউনিটের ঋণ বেড়ে হয়েছে ১৭ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা।
ইসলামী ব্যাংকের অফশোর ইউনিটের ঋণ যে গতিতে বেড়েছে, তা অন্য কোনো ব্যাংকের ক্ষেত্রে ঘটেনি। ২০২১ সালে ব্র্যাক ব্যাংকের অফশোর ইউনিটের ঋণ ছিল ৩ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা, যা ২০২২ সালে বেড়ে ৪ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা এবং গত বছরের সেপ্টেম্বরে ৫ হাজার ৯৮০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়।
অন্যদিকে ২০২১ সালে এই ইউনিটে প্রাইম ব্যাংকের ঋণ ছিল ৪ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা, যা ২০২২ সালে বেড়ে হয় ৪ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা। গত বছরের সেপ্টেম্বরে তা ৫ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকায় ওঠে। ফলে ইসলামী ব্যাংকের এই ইউনিটের ঋণ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় এসব উদ্ঘাটনও হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
দেশে ১৯৮৫ সালে অফশোর ব্যাংকিংয়ের অনুমোদন দেওয়া হলেও এ-সংক্রান্ত নীতিমালা জারি হয় ২০১৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। এখন দেশের ৩৯টি ব্যাংক অফশোর ইউনিটের মাধ্যমে এই ব্যবসা করছে। এর মধ্যে এবি ব্যাংকের অফশোর ইউনিটের মাধ্যমে অর্থ পাচারের একাধিক ঘটনা উদ্ঘাটন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটির অফশোর ঋণের ৬৮ শতাংশই এখন খেলাপি। এটির অফশোর ইউনিটের ঋণ ৭৭৭ কোটি টাকা, আর খেলাপির পরিমাণ ৫৩৫ কোটি টাকা।
এরপরই অফশোর ইউনিটে ব্র্যাক ব্যাংকের খেলাপি ১৩৬ কোটি টাকা, ইস্টার্ণ ব্যাংকের ২০৭ কোটি টাকা, প্রিমিয়ার ব্যাংকের ৭৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া বিদেশি খাতের এইচএসবিসি ব্যাংকের ৪২১ কোটি টাকা, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের ১৪৫ কোটি টাকা ও উরি ব্যাংকের ৩৬ কোটি টাকা এখন খেলাপি।