নতুন মুদ্রানীতি

মূল্যস্ফীতি কমানোর উদ্যোগ নেই   

গতকাল বৃহস্পতিবার ওয়েবসাইটে নতুন মুদ্রানীতি প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে চলতি অর্থবছরের জন্য মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ। 

দ্রব্যমূল্য বেড়ে দীর্ঘদিন ধরে মানুষ কষ্টে জীবন কাটাচ্ছেন। এ জন্য বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ১৫ মাস ধরে ৯ শতাংশের ওপরে। এই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কাজ। ডলারের দাম কৃত্রিমভাবে আটকে রাখা ও ছয়-নয় সুদহার চালু রাখাকে দায়ী করা হয় উচ্চ মূল্যস্ফীতির জন্য। সুদহার ও টাকার সরবরাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। তবে এবারের মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহারে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি।

নতুন মুদ্রানীতিতে ডলারের দামেরও কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম ১১৭ টাকায় ধরে রাখার ঘোষণা দিয়েছে। ফলে ব্যাংকঋণের সুদের হারের যে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা রয়েছে, তা কিছুটা কমে আসবে হবে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তাতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা। যদিও নতুন মুদ্রানীতিতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ। 

গতকাল বৃহস্পতিবার প্রকাশিত মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার আর না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে আমদানি ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি বা বিধিনিষেধ শিথিল করার ঘোষণা দিয়েছে সংস্থাটি। যদিও বলা হয়েছে নতুন মুদ্রানীতি আগের মতো সংকোচনমূলক। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের জন্য এই মুদ্রানীতি প্রকাশ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার কারণে ছয় মাস ধরে সাংবাদিকেরা বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুষ্ঠান বর্জন করে আসছেন। এ কারণে এবার সংবাদ সম্মেলন না করে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে নতুন মুদ্রানীতি প্রকাশ করা হয়।

মুদ্রানীতির মূল ঘোষণা

এবারের মুদ্রানীতিতে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ, গত জুন পর্যন্ত যা একই ছিল। তবে সরকারি খাতের ঋণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ দশমিক ২ শতাংশ, গত জুন পর্যন্ত যা ছিল ১২ দশমিক ৮ শতাংশ। এ জন্য আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ ঋণের মোট প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে ১০ দশমিক ৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুনে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে শরিয়াহ ভিত্তিক পাঁচ ব্যাংক ও প্রচলিত ধারার কয়েকটি ব্যাংককে ধার দেয়। এতে জুনে রিজার্ভ মানির (ছাপানো টাকা) প্রবৃদ্ধি হয় ৭ দশমিক ৯ শতাংশ, আগামী ডিসেম্বরে তা ২ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। যদিও গত জুন পর্যন্ত রিজার্ভ মানির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ছিল ঋণাত্মক ১ শতাংশ। নতুন মুদ্রানীতিতে প্রকৃত বৈদেশিক সম্পদের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ, গত জুনে যা ছিল ২ দশমিক ৩ শতাংশ। মুদ্রানীতিতে এ বিষয়ে বলা হয়েছে, অফশোর ব্যাংকিং, বিদেশফেরতদের বৈদেশিক মুদ্রার হিসাব খোলা ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধির ফলে বিনিময় হারের ওপর চাপ কমবে ও রিজার্ভ বাড়বে।

মুদ্রানীতিতে ডলারের দাম ১১৭ টাকায় রাখার ঘোষণা দিয়ে ভবিষ্যতে বাজারভিত্তিক করার ইঙ্গিত দেওয়া হয়। পাশাপাশি আমদানি ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ শিথিল করার ঘোষণা দিয়ে বলা হয়, এখন থেকে গাড়ি, ফলমূল, ফুল ও প্রসাধনী আমদানির ক্ষেত্রে শুধু ঋণপত্রের বিপরীতে নগদ অর্থ জমা দিতে হবে। এর বাইরে অন্য পণ্য আমদানিতে অগ্রিম অর্থ জমার বিষয়টি শিথিল করা হবে।

চ্যালেঞ্জ যা

মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ কয়েকটি সামষ্টিক অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধির জন্য বাধা। এই চ্যালেঞ্জগুলো দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় পক্ষ থেকে এসেছে, যা নীতিনির্ধারকদের জন্য কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। ক্রমাগত উচ্চ মূল্যস্ফীতির ফলে ক্রয়ক্ষমতা ও প্রকৃত আয় হ্রাস পাচ্ছে এবং আয়বৈষম্য বেড়ে যাচ্ছে। ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলকে ব্যাহত করছে এবং খাদ্য ও জ্বালানির মতো প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করেছে, ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে। উৎপাদন বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কৃষি ও ক্ষুদ্র-মাঝারি খাতে ঋণের প্রবাহ বৃদ্ধি করবে।

মুদ্রানীতিতে আরও বলা হয়েছে, চলমান ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে অনিশ্চয়তা রয়েছে। উন্নত দেশগুলো অর্থনীতিতে নীতি সুদহার কমানোর বিনিময় হার প্রভাবিত হতে পারে। বাংলাদেশের আমদানিনির্ভরতার কারণে বৈশ্বিক পণ্যমূল্যের ওঠানামা বিশেষ করে খাদ্য ও জ্বালানি মূল্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

মুদ্রানীতিতে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে অদূর ভবিষ্যতে সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে মূল্যস্ফীতি, বিনিময় হারের অস্থিরতা, রাজস্ব স্বল্পতা ও আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা।