কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, এমন অর্থের পরিমাণ প্রায় ১০০ কোটি ডলার। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এই অর্থ পাচার হয়েছে।
দেশে ফেরত আসছে না রপ্তানি আয়ের একটা অংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদেরই ধারণা, দুই বছর ধরে বিদেশে আটকে আছে প্রায় ১০০ কোটি ডলার। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই অর্থ আসলে পাচার হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে এই ডলার দেশে ফেরত আনতে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই উদ্যোগ কতটা কার্যকর হবে, অর্থনীতিবিদেরা সে ব্যাপারে সন্দিহান।
এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রপ্তানি প্রত্যাবাসন কোটার (ইআরকিউ) ৫০ শতাংশ দ্রুত সময়ে নগদায়ন করার নির্দেশ দিয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা আশা করছেন, এসব পদক্ষেপে বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়বে। এখন আমদানিতে চাহিদামতো ডলার দিতে পারছে না ব্যাংকগুলো। ফলে ঋণপত্র খোলা কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা মনে করছেন, রপ্তানি আয়ের অর্থ দেশে ফিরে এলে রিজার্ভের ওপর চাপ কমবে। রপ্তানি আয় ১২০ দিনের মধ্যে দেশে না এলে তা অর্থ পাচার হিসেবে গণ্য হয়।
তবে ডলারের দাম বাজারের ওপর না ছেড়ে দেওয়ায় এই উদ্যোগের ফলেও সংকট কাটবে না বলে মনে করছেন ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, ডলারের সরবরাহ বাড়াতে দাম বাজারভিত্তিক করার বিকল্প নেই। ডলারের কম দামের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার আরেক উৎস প্রবাসী আয় কমছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, এত দিন বিদেশ থেকে অর্থ না এলে তা পাচার হিসেবে গণ্য হয়। এখন কেউ সহজেই দেশে অর্থ আনবে না। এদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত পদক্ষেপ নিতে হবে। রপ্তানিকারকদের ডলার নগদায়নের ফলে এক মাসে কিছুটা সরবরাহ বাড়বে। তবে এখন যারা ডলার বিক্রি করে দেবে, তারা ভবিষ্যতে সংকটে পড়বে।
মূল সমস্যা ডলারের দাম বাজারভিত্তিক না করা। বড় দুর্নীতি, অর্থ পাচার না ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন কারা বেশি দাম নিল, এ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক, পিআরআই
বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার–সংকট কাটাতে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে আসছে। সর্বশেষ বেশি দামে ডলার কেনা ও বিক্রির অভিযোগে ১০ ব্যাংকের ট্রেজারিপ্রধানদের বিরুদ্ধে জরিমানা করা হয়। ওই জরিমানার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আপিল করেছেন ওই কর্মকর্তারা। এখন তাঁদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। জরিমানার টাকা জমার শেষ সময় ছিল গত সোমবার।
ট্রেজারিপ্রধানদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা প্রসঙ্গে আহসান এইচ মনসুর বলেন, মূল সমস্যা ডলারের দাম বাজারভিত্তিক না করা। বড় দুর্নীতি, অর্থ পাচার না ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন কারা বেশি দাম নিল, এ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এর ফলে বড় অপরাধীরা আরও উৎসাহিত হবে।
বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানি হয়েছে, এমন কিছু আয় সময়মতো দেশে আসছে না। ডলার-সংকট কাটাতে তাই বাংলাদেশ ব্যাংক এসব আয় দেশে ফিরিয়ে আনতে চাইছে। তবে এর মধ্যে অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। কেউ কেউ দেশ ছেড়ে চলে গেছে।
২ অক্টোবর ব্যাংকগুলোকে দেওয়া চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানিকারকদের মাধ্যমে সম্পূর্ণ রপ্তানি মূল্য ৩১ অক্টোবরের মধ্যে দেশে আনতে হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মূল্য প্রত্যাবাসনে ব্যর্থ হলে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। জানা গেছে, এই বিধিতে মামলা করার ব্যবস্থা আছে। নিয়ম অনুযায়ী, পণ্য রপ্তানি হওয়ার ১২০ দিনের মধ্যে অর্থ দেশে আনতে হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন সময় রপ্তানি হয়েছে, এমন প্রায় ১০০ কোটি ডলারের আয় দেশে আসেনি। অবশ্য এর মধ্যে জাল-জালিয়াতি, ভুয়া রপ্তানি, ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে যাওয়া সম্পর্কিত রপ্তানি আয়ও রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, হল-মার্ক, বিসমিল্লাহ, ক্রিসেন্ট গ্রুপের ভুয়া রপ্তানি বিলও এর মধ্যে রয়েছে। পাশাপাশি করোনার সময় দেউলিয়া হয়ে পড়েছে, এমন ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের কাছেও অর্থ আটকা পড়েছে। এসব নিয়ে বিদেশে মামলা চলছে। ফলে এসব আয় আনতে সময়ের প্রয়োজন হবে। তবে এখনো প্রত্যাবাসন হয়নি, এমন অর্ধেকের বেশি আয় দ্রুত দেশে ফেরানো যেতে পারে।
এদিকে রপ্তানিকারকেরা আয়ের একটি অংশ নিজেদের কাছে রাখতে পারেন, যা রপ্তানি প্রত্যাবাসন কোটায় (ইআরকিউ) জমা থাকে। রপ্তানিকারকদের কাছে এমন আয় আছে প্রায় ৬৫ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংক এই আয়ের ৫০ শতাংশ দ্রুত সময়ে নগদায়ন করার নির্দেশ দিয়েছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকে ডলারের সরবরাহ বাড়বে বলে আশা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এ নিয়ে ব্যাংকগুলোর কাছে পাঠানো চিঠিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক লিখেছে, ইআরকিউ হিসেবে গত ২১ সেপ্টেম্বরের স্থিতির ভিত্তিতে ৫০ শতাংশ সংরক্ষণ করে অবশিষ্ট অংশ প্রচলিত বিনিময় হারে নগদায়ন করতে হবে। এর ফলে বাজারে ৩০ কোটি ডলার সরবরাহ বাড়ার আশা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্যাংকগুলো এখন ১১০ টাকা দরে প্রবাসী ও রপ্তানি আয় কিনছে। ফলে ইআরকিউ হিসেবে থাকা ডলার বিক্রি করে রপ্তানিকারকেরা একই দাম পাবেন।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব সিদ্ধান্তের কারণে ডলারের সরবরাহ কিছুটা বাড়বে। ডলারের সংকট মেটাতে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। তবে যে দামে প্রবাসী আয় কিনতে চাইছি, সেই দামে পাচ্ছি না। এর ফলে চাহিদামতো ঋণপত্র খোলা সম্ভব হচ্ছে না।’
গত বছরের মার্চে শুরু হওয়া ডলার-সংকট এখনো কাটেনি। এই সময়ে ডলারের দাম ৮৭ থেকে বেড়ে ১১০ টাকা ৫০ পয়সায় উঠেছে। এরপরও চাহিদামতো ডলার মিলছে না। তবে ব্যাংকের মালিকানার সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ী ও বড় ব্যবসায়ীরা এ ক্ষেত্রে কিছু বাড়তি সুবিধা পাচ্ছেন বলে জানা গেছে। গত জুলাই-আগস্ট সময়ে ঋণপত্র খোলা হয়েছে ১০৫ কোটি ডলারের, আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ১২৮ কোটি ডলার। ফলে ঋণপত্র খোলা কমেছে ১৮ শতাংশ, আর এই সময়ে ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে ২২ শতাংশের বেশি।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে হয়েছে ২ হাজার ৬৭০ কোটি ডলার। গত বছরের একই সময়ে যা ছিল ৩ হাজার ৬৪০ কোটি ডলার। ফলে এক বছরে রিজার্ভ কমেছে ৯৭০ কোটি ডলার।
তবে ব্যাংকগুলোতে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। তাঁরা বলছেন, এক বছর আগে বেশির ভাগ ব্যাংকে ডলারের চাহিদার চেয়ে জোগান কম ছিল, ফলে ডলার ধারণ ঋণাত্মক হয়ে পড়েছিল। তবে এখন বেশির ভাগ ব্যাংকে ডলারের মজুত আছে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোতে ডলারের ধারণ ৩৩০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে।
তবে সাতটি মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স স্থগিত করার পর খোলাবাজারে নগদ ডলারের সংকট বেড়েছে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, রাজধানীর বেশির ভাগ মানি চেঞ্জার ডলার বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে। খোলাবাজারে ডলারের দাম উঠেছে ১১৯-১২০ টাকা। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ব্যাংকগুলোর কাছে নগদ ২ কোটি ৯০ ডলার আছে, যা গ্রাহকেরা ব্যাংক থেকে কিনতে পারেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক প্রথম আলোকে বলেন, খোলাবাজারে ডলারের দাম সব সময় বেশি ছিল। ব্যাংক থেকে নিলে দাম কম পড়বে। ব্যাংকে ডলারের সরবরাহ বাড়াতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রবাসী আয়ও বাড়ছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে রিজার্ভের ওপর চাপ কমে আসবে। ডলার বাজারের আরও উন্নতি হবে।
মেজবাউল হক জানান, চলতি মাসের প্রথম ১১ দিনে ৬৯ কোটি ৮০ লাখ ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে। তুলনায় গত বছরের একই সময়ে আয় এসেছিল ৬১ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
দেশে চলমান ডলার–সংকটের মধ্যে বিদেশে আটকে থাকা রপ্তানি আয় ফেরত আনার উদ্যোগকে কেউ কেউ স্বাগত জানিয়েছেন। তবে তাঁরা মনে করেন, এ উদ্যোগ কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে শঙ্কা আছে। কারণ, যাঁরা ভুয়া রপ্তানি দেখিয়ে অর্থ পাচার করেছেন, তাঁরা কোনোভাবেই সেই অর্থ ফেরত আনবেন না।
এ বিষয়ে নিট পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, যারা ভুয়া রপ্তানি দেখিয়ে নামে অর্থ পাচার করেছে, তাদের ক্ষেত্রে এ সিদ্ধান্ত যথাযথ হয়েছে। রপ্তানির ডলার ফেরত আনার জন্য ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও গত বছরের জুনে সমাপ্ত অর্থবছরের রপ্তানি আয় যেমন আছে, তেমনি গত জুনে সমাপ্ত অর্থবছরের ক্ষেত্রেও রপ্তানি আয় আছে। দুই ক্ষেত্রেই একই সময়সীমা দেওয়াটা ঠিক হয়নি। এ ছাড়া বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে অনেক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান অর্থ দিতে দেরি করছে। ফলে তাতে দেশে রপ্তানি অর্থ আসতেও দেরি হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে জোর করে অর্থ ফেরত আনা হয়তো সম্ভব হবে না। তাই ক্ষেত্রবিশেষে বিষয়টির সুরাহা করতে হবে।