এসআইবিএল ও কমার্স ব্যাংকে অস্থিরতা

  • এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো কমার্স ব্যাংক থেকে ৬১০ কোটি টাকা ধার নিয়ে আর দিচ্ছে না।

  • গতকাল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাপের মুখে কমার্স ব্যাংকের ডিএমডি আব্দুল কাদের পদত্যাগে বাধ্য হন।

সরকার পরিবর্তনের পর ইসলামী ও আইএফআইসি ব্যাংক ছাড়াও বেসরকারি খাতের আরও দুটি ব্যাংকে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডকে (এসআইবিএল) এস আলম গ্রুপের হাত থেকে মুক্ত করতে মানববন্ধন করেছেন প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারধারীরা। একই গ্রুপের মালিকানাধীন বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল কাদেরকে পদত্যাগে বাধ্য করেছেন এর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

এদিকে অস্থিরতার কারণে কমার্স ব্যাংকে লেনদেন করতে গিয়ে গ্রাহকেরা বেশ সমস্যায় পড়েন। কারণ, জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা এখন ব্যাংকটিতে যাচ্ছেন না।

এস আলম মুক্ত এসআইবিএলের দাবি

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডকে (এসআইবিএল) এস আলম গ্রুপের হাত থেকে মুক্ত করতে মানববন্ধন করেছেন ব্যাংকটির কিছু শেয়ারধারী। তাঁরা গতকাল রোববার ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনের পর এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলম ও তাঁর সহযোগীরা আমানতকারীদের হাজার হাজার কোটি টাকা নামে-বেনামে তুলে পাচার করেছেন। এতে শুধু এসআইবিএল নয়, পুরো আর্থিক খাতই হুমকির মুখে পড়েছে। সাধারণ আমানতকারীরা তাঁদের জমাকৃত অর্থ প্রয়োজন অনুযায়ী তুলতে পারছেন না।

মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলনে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল হক, সাবেক পরিচালক আনিসুল হক, আসাদুজ্জামান, সুলতান মাহমুদ চৌধুরী, আব্দুর রহমান, আবুল বসর ভূঁইয়াসহ সাধারণ ও উদ্যোক্তা শেয়ারধারীরা উপস্থিত ছিলেন।

চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ ২০১৭ সালে এসআইবিএলের মালিকানায় আসে। ব্যাংকটির বর্তমান চেয়ারম্যান বেলাল আহমেদ হচ্ছেন এই গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের জামাতা। মালিকানা পরিবর্তনের সময় বাদ দেওয়া হয় কয়েকজন উদ্যোক্তা ও পরিচালককে। এরপর ব্যাংকটি থেকে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ টাকা বের করে নেওয়া হয়। সেই সঙ্গে এ ব্যাংকের চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের পটিয়ার বাসিন্দাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। যে কারণে ব্যাংকটি ইতিমধ্যে আর্থিক সংকটে পড়েছে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে রক্ষিত চলতি হিসাবেও ঘাটতিতে রয়েছে।

গতকাল সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে এস আলম গ্রুপের ‘কবল থেকে দখলমুক্ত’ করে প্রকৃত মালিক ও প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তাদের কাছে ব্যাংকটির মালিকানা হস্তান্তরের দাবি জানানো হয়।

সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়, ২০১৭ সালে অস্ত্রের মুখে এসআইবিএলের মালিকানা দখল করে নেয় তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সমর্থনপুষ্ট এস আলম গ্রুপ। ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের চরমভাবে হেনস্তা করে এক দিনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নরের যোগসাজশে অবৈধভাবে রাতের আঁধারে ব্যাংকটির মালিকানা পরিবর্তন করা হয়। এরপর ব্যাংকটি লুটপাট করা হয়।

এদিকে ব্যাংকটিতে ২০১৭ সালের পর নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারা গতকালও মতিঝিল এলাকায় অবস্থিত প্রধান কার্যালয়ের সামনে জড়ো হয়ে লাঠিসোঁটা নিয়ে অবস্থান নেন। তাঁদের বেশির ভাগই চট্টগ্রামের পটিয়া এলাকার বলে জানা যায়। এ সময় তাঁদের হাতে ২০১৭ সালের আগে নিয়োগ পাওয়া কয়েকজন কর্মকর্তা লাঞ্ছিত হন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

উনারা যথানিয়মে না এসে জোরপূর্বক চেয়ারম্যানের চেয়ারে এসে বসেছেন। আবার বর্তমান চেয়ারম্যানের নামফলক ভেঙে ফেলেছেন। এটা ঠিক হচ্ছে না। আমাদের পর্ষদ ও বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদন দিলে উনারা ব্যাংকে আসতে পারেন।
জাফর আলম, এমডি, এসআইবিএল।

জানতে চাইলে এসআইবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাফর আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘উনারা আগে ব্যাংকে ছিলেন, শেয়ার থাকলে আবার আসতে পারেন। উনারা যথানিয়মে না এসে জোরপূর্বক চেয়ারম্যানের চেয়ারে এসে বসেছেন। আবার বর্তমান চেয়ারম্যানের নামফলক ভেঙে ফেলেছেন। এটা ঠিক হচ্ছে না। আমাদের পর্ষদ ও বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদন দিলে উনারা ব্যাংকে আসতে পারেন।’

অস্থিরতা কমার্স ব্যাংকেও

বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৫১ শতাংশ শেয়ারের মালিক সরকারি খাতের ব্যাংকগুলো; বাকি শেয়ার ছিল বিকল্পধারার সাবেক মহাসচিব আবদুল মান্নানের হাতে। ২০১৬ সালে আবদুল মান্নানের শেয়ার কিনে ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নেয় এস আলম গ্রুপ। এরপর পটিয়া এলাকার নাগরিকদের ব্যাপক হারে নিয়োগ দেওয়া হয়। ব্যাংকটির ১ হাজার কর্মকর্তার মধ্যে ৭০০ জনই পটিয়া এলাকার।

কমার্স ব্যাংক থেকে বিভিন্নভাবে প্রায় ৬১০ কোটি টাকা ধার নেয় এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো। এসব ব্যাংক হলো ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক। কিন্তু ওই টাকা ফেরত আসছে না। এর ফলে তারল্যসংকটে ভুগছে কমার্স ব্যাংক। এদিকে ব্যাংকটি কর্মচারীদের স্থায়ী চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করেছে।

সরকার পতনের পর ব্যাংকে যাচ্ছেন না এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাজুল ইসলাম। গতকাল ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল কাদের অফিসে গেলে তাঁকে ঘিরে ধরেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাঁরা কেউ চাকরি স্থায়ী করার দাবি জানান, আবার কেউ পদোন্নতির দাবিতে নানা স্লোগান দেন। এই সময় কেউ কেউ ব্যাংককে এস আলম মুক্ত করার দাবি জানান। আব্দুল কাদের অপারগতা প্রকাশ করলে তাঁকে পদত্যাগে বাধ্য করেন ব্যাংকটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এ সময় সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাঁকে ব্যাংক থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যান।

এ নিয়ে বক্তব্য জানতে তাজুল ইসলাম ও আব্দুল কাদেরকে ফোন করা হলেও তাঁরা সাড়া দেননি।

সতর্কতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের

গতকাল দিনভর বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংক, এসআইবিএল, কমার্স ও আইএফআইসি ব্যাংকে নানা অস্থিরতা চলে। গত বৃহস্পতিবার ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) সামনেও মালিকানা পরিবর্তনের জন্য শেয়ারধারীরা মানববন্ধন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল রাতে এক বিজ্ঞপ্তিতে ব্যাংকে শৃঙ্খলা পরিপন্থী কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

এতে বলা হয়, ‘সম্প্রতি কিছু ব্যাংকের দপ্তরে বা কার্যস্থলে ব্যাংকের শেয়ার ধারক, বর্তমান ও প্রাক্তন কর্মকর্তা/কর্মচারী কর্তৃক শৃঙ্খলা পরিপন্থী কার্যকলাপ সংঘটিত হচ্ছে মর্মে বাংলাদেশ ব্যাংক জানতে পেরেছে। উল্লেখ্য, ব্যাংকের মালিকানা সম্পর্কিত বিরোধ নিষ্পত্তি কিংবা কর্মকর্তা/কর্মচারীদের দাবিদাওয়া পেশের সুনির্দিষ্ট আইনি প্রক্রিয়া ও নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থা রয়েছে। অনিয়মতান্ত্রিক ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী এ ধরনের কার্যকলাপ ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যক্রম ও লেনদেনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। এতে ব্যাংকের ওপর আমানতকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট দেখা দিতে পারে। দেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তি ব্যাংকিং খাতে এমন বিশৃঙ্খলা একান্তই অনভিপ্রেত। এই প্রেক্ষিতে ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখার পাশাপাশি ব্যাংকের ওপর আমানতকারীদের আস্থা অক্ষুণ্নœরাখার জন্য সংশ্লিষ্ট সব মহলের সর্বাত্মক সহযোগিতা চেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।’