গত ১০ মাসে সারা দেশে কৃষকেরা সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা শোধ করেছেন। এই সময়ে ব্যাংকটির আমানতে স্থিতি বেড়েছে ৪,৬৪৩ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি) চলতি বছরের প্রথম ১০ মাস জুলাই-অক্টোবরে ১১ হাজার ২০৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। এই ঋণ পেয়েছেন ৮ লাখ ২৩ হাজার ১৪৩ জন গ্রাহক। এর মধ্যে কৃষিঋণ ৬ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকা, যা পেয়েছেন ১ লাখ ৭১ হাজার ১৪৫ জন নতুন কৃষক। একই সময়ে সার্বিকভাবে কৃষকদের ঋণ পরিশোধও ভালো ছিল, যা পরিমাণে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা।
কৃষি খাতে অর্থায়নের ক্ষেত্রে বিশেষায়িত এই ব্যাংক জন্মের পর থেকে আর্থিক সংকটে ধুঁকছে। ধারাবাহিকভাবে লোকসান করে গেছে। এর পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে। যেমন ব্যাংকটিকে ভর্তুকি সুদে কৃষিঋণ দিতে হয়। আবার আমানত সংগ্রহ করতে হয় অন্যান্য ব্যাংকের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক সুদে।
সমস্যা আছে, এসব নিয়ে চলতে হবে। প্রতিটি শাখায় নতুন জনবল দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। পাশাপাশি কৃষকেরা যাতে জটিলতা ছাড়াই সঠিক সময়ে ঋণ পান, সেই উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। ফলে কৃষকেরা নতুন করে ঋণ পাচ্ছেন। এসব ঋণ আদায়ের হারও ভালো। দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ রাখতে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে।শওকত আলী খান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বিকেবি
এর ওপর বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে সুদ মওকুফ করতে হয়। এ ছাড়া পোশাক খাতে বড় অঙ্কের ঋণ আটকে আছে। ব্যাংকটি এখন চলছে অর্ধেক জনবল নিয়ে। ইউনিয়ন পর্যায়ে কোনো কোনো শাখা চালানো হচ্ছে তিন-চারজন কর্মকর্তা দিয়ে। ফলে ঋণের ক্ষেত্রে যথাযথ তদারকিও করা যাচ্ছে না।
গত মে মাসে বিকেবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগ দেন শওকত আলী খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সমস্যা আছে, এসব নিয়ে চলতে হবে। প্রতিটি শাখায় নতুন জনবল দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। পাশাপাশি কৃষকেরা যাতে জটিলতা ছাড়াই সঠিক সময়ে ঋণ পান, সেই উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। ফলে কৃষকেরা নতুন করে ঋণ পাচ্ছেন। এসব ঋণ আদায়ের হারও ভালো। দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ রাখতে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে।’
গত বছরের ডিসেম্বরে বিকেবিতে গ্রাহকদের মোট আমানত ছিল ৩৮ হাজার ৮৬ কোটি টাকা, যা গত অক্টোবরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা। অন্যদিকে এই ১০ মাসে ঋণ ২৭ হাজার ৮৯০ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ৩০ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা। এই ১০ মাসে বিকেবিতে আমানতের স্থিতি ৪ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা ও ঋণের স্থিতি ২ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা বেড়েছে।
এই সময়ে খেলাপি ঋণও ৪২১ কোটি টাকা বেড়ে ৩ হাজার ৪৬ কোটি টাকায় উঠেছে, যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। বিকেবি গত ১০ মাসে ৯ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকার ঋণ আদায় করেছে।
ব্যাংকটির দেওয়া কৃষিঋণের সুদের হার এখন ৯ দশমিক ৭০ শতাংশ। অন্যদিকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
সারা দেশে ব্যাংকটির রয়েছে ১ হাজার ৫০টি শাখা। ফলে অন্যান্য ব্যাংকের তুলনায় প্রবাসী আয়ও ভালো পাচ্ছে। গত ১০ মাসে ব্যাংকটি ৬ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকার সমপরিমাণ প্রবাসী আয় আনতে পেরেছে। এই সময়ে আমদানি ব্যবসা হয়েছে ৬ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা, রপ্তানি ব্যবসা হয়েছে ৮৬৬ কোটি টাকা।
গত অক্টোবর শেষে ব্যাংকটির মোট ঋণগ্রহীতার সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩৩ লাখ ৭১ হাজার ৪১৮। ব্যাংকটির ঋণের বড় অংশ শস্য খাতে। এরপরই রয়েছে পশুসম্পদ, মৎস্য, তৈরি পোশাক, কৃষিভিত্তিক শিল্প, এসএমই, পরিবহন ও সংরক্ষণাগার এবং সেচযন্ত্র।
ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ এখন ৩ হাজার ৪৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে শীর্ষ ২০ খেলাপি গ্রাহকের কাছে আটকে আছে ৮৬৮ কোটি টাকা। এসব গ্রাহকের কাছ থেকে চলতি বছরে আদায় হয়েছে মাত্র ১০ কোটি টাকা। এই গ্রাহকদের ঋণের বড় অংশ দেওয়া হয়েছে ২০০৭-১২ সালের মধ্যে। শীর্ষ ঋণখেলাপিদের মধ্যে রয়েছে ফেয়ার ইয়ার্ন প্রসেসিং (২৬৭ কোটি টাকা), ফিয়াজ গ্রুপ (১০৮ কোটি), চট্টগ্রামের আনিকা এন্টারপ্রাইজ (১০১ কোটি), আফিল এগ্রো লিমিটেড (৮১ কোটি), চট্টগ্রামের এস এ অয়েল (৭৫ কোটি) ও এন এ করপোরেশন (২৫ কোটি টাকা), খুলনার হিমালয় আইস (২২ কোটি), ফেয়ার ইয়ার্ন টুয়েস্টিং (২১ কোটি), আর এন সোয়েটার (২১ কোটি), মিমটেক্স নিটিং (২০ কোটি)।
২০ কোটি টাকার কম খেলাপি এমন গ্রাহকেরা হলো ব্রাদার্স অ্যাসোসিয়েট, অঙ্গন লেদার কমপ্লেক্স, অ্যাকোয়া রিসোর্সেস, রোজবার্গ ইন্ডাস্ট্রিজ, ইব্রাহিম লেদার, এসমা পোলট্রি, পাটোয়ারি কোল্ড স্টোরেজ, ফেয়ার প্যাক, ফরিদপুর সুগার মিলস ও কার্টন নির্মাণ লিমিটেড।
ব্যাংকটির কর্মকর্তারা জানান, কৃষি খাতের বাইরে ঋণ দেওয়ার উদ্যোগটি ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। এ জন্য এত বড় খেলাপি গ্রাহক ব্যাংকে যুক্ত হয়েছে। এসব গ্রাহক অন্য ব্যাংকেও খেলাপি। এই কারণে এ-জাতীয় ঋণ দেওয়া থেকে বর্তমানে দূরে থাকছেন।
কৃষি ব্যাংকের এমডি শওকত আলী খান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘শীর্ষ খেলাপিদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। তাদের ব্যবসা চালু করে ঋণ ফেরত দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। আশা করছি ইতিবাচক অগ্রগতি হবে।’