কোনো বিদেশি ঋণ যদি এক বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে না হয়, তাহলে তা প্রকৃত রিজার্ভে যোগ হয়।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) অর্থ দিয়েই তাদের দেওয়া ঋণের শর্ত পূরণ করছে বাংলাদেশ। বৈদেশিক মুদ্রার প্রকৃত রিজার্ভ বা মজুত রাখার বিষয়ে সংস্থাটি যে লক্ষ্য দিয়েছিল, তা গত চার ত্রৈমাসিকে পূরণ করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য কয়েক দফা শর্ত শিথিল করা হয়েছে। অবশ্য পঞ্চম ত্রৈমাসিকে, অর্থাৎ চলতি জুনের শেষেই সে লক্ষ্য পূরণ হতে চলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে। সূত্রটি জানায়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের জন্য ঋণের তৃতীয় কিস্তিতে ১১৫ কোটি মার্কিন ডলার ছাড় করেছে। এ ডলার বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে যুক্ত হয়েছে। সম্প্রতি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক ফর রিকনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এবং কোরিয়া থেকে প্রায় ৯০ কোটি ডলার এসেছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে মোট রিজার্ভ বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রকৃত রিজার্ভও বেড়েছে।
এ নিয়ে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঋণ করে রিজার্ভ বাড়ানোর মধ্যে কোনো স্বস্তি দেখছি না। এতে সংখ্যার হিসাবে বাড়লেও সত্যিকার অর্থে স্বস্তি মিলবে না। আমরা যদি রপ্তানি, প্রবাসী আয় ও বিনিয়োগ বাড়িয়ে রিজার্ভের উন্নতি করতে না পারি, তাহলে সামনে আরও চাপ আসবে। কারণ, বিদেশি ঋণ শোধ দিতে হবে।’
সেলিম রায়হান আরও বলেন, ‘বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নানা চাপ আসছে। আমাদের অর্থনীতির মূল ভিত্তিগুলো দুর্বল অবস্থায় রয়ে গেছে। ফলে উদ্বেগের জায়গাগুলো রয়েই যাচ্ছে। এখন প্রয়োজন টেকসইভাবে রিজার্ভ বাড়ানো ও আর্থিক খাত সংস্কারে বড় উদ্যোগ নেওয়া।’
প্রকৃত রিজার্ভ হলো দায়হীন রিজার্ভ। আইএমএফের এসডিআর খাত, ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা ক্লিয়ারিং হিসাবে রাখা ডলার ও এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) বিলের জন্য জমা থাকা ডলার বাদ দিয়ে ডলারের যে হিসাব করা হয়, সেটিই হলো প্রকৃত রিজার্ভ। এর বাইরে রিজার্ভের আরও দুটি হিসাব রয়েছে। তার একটি হলো মোট রিজার্ভ, আরেকটি আইএমএফের হিসাবপদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী রক্ষিত রিজার্ভ। তবে আইএমএফের চাওয়া শুধু নিট বা প্রকৃত রিজার্ভ কত হবে, সেটি।
ঋণ করে রিজার্ভ বাড়ানোর মধ্যে কোনো স্বস্তি দেখছি না। এতে সংখ্যার হিসাবে বাড়লেও সত্যিকার অর্থে স্বস্তি মিলবে না।সেলিম রায়হান, নির্বাহী পরিচালক, সানেম
প্রকৃত রিজার্ভের হিসাব কীভাবে হবে, সেই সূত্রও ঋণ দেওয়ার সময় বাংলাদেশকে জানিয়ে দিয়েছিল আইএমএফ। কোনো বিদেশি ঋণ যদি এক বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে না হয়, তাহলে তা প্রকৃত রিজার্ভ হিসেবে যুক্ত করা যায়। এখন বাংলাদেশ যেসব ঋণ পেয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগই দীর্ঘমেয়াদি। ফলে প্রকৃত রিজার্ভের শর্ত পূরণ হয়েছে।
ঋণের শর্ত হিসেবে বাংলাদেশকে নির্দিষ্ট সময় পরপর কী পরিমাণ প্রকৃত রিজার্ভ রাখতে হবে, তা-ও ঠিক করে দিয়েছিল আইএমএফ। সে অনুযায়ী, প্রতি তিন মাস পরপর আইএমএফের শর্ত মেনে রিজার্ভ সংরক্ষণ করতে হচ্ছে।
সংস্থাটির শর্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশকে চলতি জুনের শেষে প্রকৃত রিজার্ভ ২ হাজার ১০ কোটি ডলার রাখতে বলা হয়েছিল। পরে বাংলাদেশের অনুরোধে তা কমিয়ে ১ হাজার ৪৭৮ কোটি ডলারের লক্ষ্য দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে জানান, জুন মাসের শেষ কর্মদিবস হওয়ায় গত বৃহস্পতিবার একদিকে ঋণের অর্থ আসে, অন্যদিকে আবার নানা ঋণের কিস্তিও শোধ করা হয়। এরপরও মোট রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭১৫ কোটি ডলার, যা গত বুধবার ছিল ২ হাজার ৪৬২ কোটি ডলার। গত বৃহস্পতিবার প্রকৃত বা দায়হীন রিজার্ভ বেড়ে ১ হাজার ৫৫০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে, যা আইএমএফের বেঁধে দেওয়া ১ হাজার ৪৭৮ কোটি ডলারের লক্ষ্যের চেয়ে বেশি।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক প্রথম আলোকে বলেন, জুনের শেষে রিজার্ভ বেড়েছে। এতে আইএমএফের শর্ত পূরণ হবে। মাস শেষে জানা যাবে, প্রকৃত রিজার্ভ কত।
আইএমএফ গত সোমবার বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তির আওতায় তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের অনুমোদন দেয়। এর আগে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সংস্থাটির অনুমোদিত ঋণের প্রথম কিস্তিতে ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পেয়েছিল বাংলাদেশ। আর গত ডিসেম্বরে পেয়েছিল দ্বিতীয় কিস্তি, যা পরিমাণে ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার। এখন তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের ফলে বাংলাদেশ সব মিলিয়ে তিন দফায় আইএমএফের কাছ থেকে প্রায় ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে। ঋণের বাকি ২৩৯ কোটি ডলার আরও চার কিস্তিতে পাওয়া যাবে।
অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ ২০২২ সালের জুলাই মাসে আইএমএফের কাছে ঋণ চায়। বাংলাদেশের ঋণ আবেদনের ছয় মাস পর সংস্থাটি গত বছরের ৩০ জানুয়ারি শর্ত সাপেক্ষে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করে। আইএমএফ তখন জানায়, শর্তপূরণ সাপেক্ষে ২০২৬ সাল পর্যন্ত মোট সাত কিস্তিতে এই ঋণ দেওয়া হবে। সংস্থাটির পরামর্শে ঋণের সুদ ও ডলারের দাম নির্ধারণ বাজারভিত্তিক করাসহ নানা পদক্ষেপ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। আইএমএফ বলেছে, বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেবে—এই শর্তে রিজার্ভের লক্ষ্য পূরণের শর্তে ছাড় দেওয়া হয়েছে।
এদিকে দেশে আড়াই বছর ধরে চলা ডলার-সংকট এখনো কাটেনি। ব্যাংকে প্রবাসী ও রপ্তানি আয় কেনায় ডলারের দাম এখন ১১৭ টাকা নির্ধারণ করে রাখলেও তারা আরও বেশি দামে কিনছে, বিক্রি করছে তারও বেশিতে। তবে সংকট আগের চেয়ে এখন অনেকটা কম।