নানা অনিয়ম ও বেনামি ঋণের কারণে আলোচনায় থাকা বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্প্রতি ব্যাংক দুটি পরিদর্শনে বিভিন্ন ঋণ অনিয়মের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় গতকাল সোমবার এ সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দুটি ব্যাংকই চট্টগ্রামভিত্তিক একটি শিল্প গ্রুপের মালিকানাধীন।
ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ঋণ অনিয়মের বিষয়ে নানা আলোচনার কারণে ব্যাংক দুটির আমানতকারীরাও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থায় অনেকে অন্য ব্যাংকে আমানত সরিয়ে নিচ্ছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্তে আমানতকারীরা আশ্বস্ত হবেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা। এদিকে ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির অভিযোগ অনুসন্ধান করে চার মাসের প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
পর্যবেক্ষক নিয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক প্রথম আলোকে বলেন, সম্প্রতি যেসব আলোচনা হচ্ছে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি ব্যাংকে পরিদর্শন চলছে। এর মধ্যে উল্লিখিত ব্যাংক দুটিকে বেশ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়। এসব নির্দেশনা অনুসরণ করা হচ্ছে কি না, পর্যবেক্ষকেরা তা তদারক করবেন। পাশাপাশি পর্যবেক্ষকেরা তাদের অর্পিত দায়িত্ব পালন করবেন।
জানা গেছে, ইসলামী ব্যাংকে পর্যবেক্ষক করা হয়েছে ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের পরিচালক আবুল কালামকে। আর ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পেমেন্ট সার্ভিস বিভাগের পরিচালক মোতাসিম বিল্লাহকে। এসব কর্মকর্তা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ, নির্বাহী ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় অংশ নেবেন।
ব্যাংক খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে ব্যাংক দুটির যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই উদ্যোগ না নিলে গ্রাহকেরা আরও বেশি আস্থা হারাত। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক থাকা অবস্থায় ইসলামী ব্যাংকের মালিকানায় পরিবর্তন আসে। তাই পর্যবেক্ষকের ভূমিকা নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ঋণ অনিয়ম ও জঙ্গি অর্থায়ন রোধে ২০১০ সালের ডিসেম্বরে ইসলামী ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২০ সালের মার্চে ওই পর্যবেক্ষক সরিয়ে নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তার আগে ২০১৭ সালে ব্যাংকটির মালিকানায় পরিবর্তন হয়। পর্যবেক্ষক তুলে নেওয়ার পর ব্যাংকটির ঋণে নানা ধরনের অনিয়মের ঘটনা ঘটে।
চলতি বছর ইসলামী ব্যাংক থেকে সাত প্রতিষ্ঠানের নামে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ তুলে নেওয়া হয় ১ থেকে ১৭ নভেম্বর। যার পরিমাণ ২ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। একইভাবে বেসরকারি খাতের সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল) ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকও এসব প্রতিষ্ঠানকে ২ হাজার ৩২০ কোটি টাকা ঋণ দেয়। ফলে এ তিন ব্যাংকের কাছে প্রতিষ্ঠানগুলোর সুদসহ দেনা বেড়ে হয়েছে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ, আগ্রাবাদ, রাজশাহী শাখা, রাজশাহী নিউমার্কেট, পাবনা ও রাজধানীর গুলশান, গুলশান-২, ফার্মগেট, নবাবপুর রোড, বারিধারা শাখায় বেশি অনিয়ম হয়েছে। এসব অনিয়মের ঘটনা খতিয়ে দেখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একইভাবে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ও এসআইবিএলের বেশ কয়েকটি শাখায়ও ঋণ অনিয়মের ঘটনা ঘটে।
ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘পর্যবেক্ষকের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি দেখভাল করলে ভালো হবে। আর যেসব ঋণ গেছে, তা আশা করছি সময়মতো আদায় হবে। দেশে আনা খাদ্যপণ্য বিক্রি হলেই ব্যাংকে টাকা আসবে। তবে বিভিন্ন ধরনের প্রচারণার কারণে আমানতকারীরা টাকা উঠিয়ে নেওয়া শুরু করেছিল। এখন তা বন্ধ হয়েছে।’