এমএলএ চুক্তি করে এবং অটোমেটিক এক্সচেঞ্জ অব ইনফরমেশনের সদস্য হয়ে অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নিতে পারে বাংলাদেশ।
সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ বাড়ছে। কারা এই অর্থ জমা করছেন, তা নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে। তবে দেশ থেকে অর্থ পাচার ঠেকাতে বাংলাদেশের উদ্যোগ ও ইচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, বাংলাদেশ জানতেই পারছে না যে কারা অর্থ পাচার করে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে জমা রাখছেন।
শুধু সুইজারল্যান্ডের ভৌগোলিক কাঠামোর মধ্যে নয়, দেশটির বাইরে ওই দেশের ব্যাংকগুলোর যেসব শাখা রয়েছে, সেগুলোও সুইস ব্যাংক হিসেবে পরিচিত। সে অনুযায়ী আমেরিকায় সুইস ব্যাংকের কোনো শাখায় প্রবাসী বাংলাদেশিরা অর্থ রাখুন আর পাচারকারীরা সুইজারল্যান্ডে নিয়ে জমা করুন—দুটিই সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থ হিসেবে বিবেচিত। অর্থাৎ সুইস ব্যাংকে অনেক বাংলাদেশির বৈধ অর্থও রয়েছে।
দেশ থেকে অর্থ পাচার ঠেকাতে নীতিমালা প্রণয়ন ও সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। ২০১৩ সালে এগমন্ট গ্রুপের সদস্যপদ পায় বিএফআইইউ।
এগমন্ট গ্রুপ হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের এফআইইউগুলোর সমন্বয়ে গঠিত একটি আন্তর্জাতিক ফোরাম, যারা অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়নসংক্রান্ত তথ্য নিয়ে কাজ করে। সুইজারল্যান্ডও এই গ্রুপের সদস্য। ফলে এই গ্রুপের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ কিছু তথ্য পাচ্ছে।
সম্প্রতি আদালতে জানানো হয়েছে, ৬৭ জন ব্যক্তি সম্পর্কে সুইজারল্যান্ডের কাছে তথ্য চেয়েছিল বিএফআইইউ। এর মধ্যে একজনের বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। যাঁর বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে, তাঁর মালিকানাধীন গ্রুপের খাদ্য, রড, সিমেন্ট ও গণমাধ্যম খাতে বড় বিনিয়োগ রয়েছে। এই গ্রুপের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) জানিয়েছে বিএফআইইউ।
জানতে চাইলে বিএফআইইউ প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুইজারল্যান্ড থেকে তথ্য পেতে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। এগমন্টের সদস্য হিসেবে দেশটির এফআইইউ থেকে আমরা তথ্য পাচ্ছি। তবে দেশটি তথ্য দেওয়ার ব্যাপারে খুবই রক্ষণশীল। চাইলেই সবার তথ্য পাওয়া যায় না।’
সুইজারল্যান্ডের এফআইইউর কাছে শুধু সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য জমা থাকে। আর এফআইইউ থেকে তথ্য পেতে হলে পুরো পরিচয়, পাসপোর্ট নম্বর, সুনির্দিষ্ট অপরাধের বিবরণসহ তথ্য পেতে আবেদন করতে হয়। ফলে চাইলেও এই মাধ্যমে দেশটির ব্যাংকে জমা হওয়া বাংলাদেশিদের তথ্য পাওয়া সম্ভব নয়।
এখন প্রশ্ন উঠেছে, এই মাধ্যমে পর্যাপ্ত তথ্য না পেলে বাংলাদেশের কী করার আছে। এখন দেশটির সঙ্গে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট (এমএলএ) চুক্তি করতে পারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত শুধু ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে এই চুক্তি করেছে।
আরেকটি উপায় হতে পারে, অটোমেটিক এক্সচেঞ্জ অব ইনফরমেশনের (এইওআই) সদস্য হওয়া। তাহলে বাংলাদেশ আরও সহজে তথ্য পেতে পারে। কারণ, বিশ্বের ১২১টি দেশ সুইস ব্যাংক থেকে এই প্রক্রিয়ায় আমানতকারীদের তথ্য পাচ্ছে। কেউ যদি নিজ দেশে কর ফাঁকি দিয়ে সুইস ব্যাংকে অর্থ জমা রাখেন, তাহলে তাঁর দেশকে এইওআইর আওতায় সেই তথ্য দিতে সুইস ব্যাংকগুলো বাধ্য।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ জন্য প্রথমে উদ্যোগ নিতে হবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)। কারণ, কর ফাঁকির বিষয়টি দেখভালের একমাত্র দায়িত্ব এনবিআরের। আর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেও যোগাযোগ বাড়াতে হবে।
বিএফআইইউর সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা বলছেন, অর্থ পাচার ঠেকাতে ও অর্থ ফেরত আনতে পুরো দেশকে একযোগে কাজ করতে হবে। কারণ, কোনো দেশই অন্য দেশে অর্থ ফেরত যাক এটা চায় না। এ জন্য দুদক, এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংককে একযোগে সক্রিয় হতে হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অন্য দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে।
২০২১ সাল শেষে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ, যা বাংলাদেশের প্রায় ৮ হাজার ২৭৬ কোটি টাকার মতো (প্রতি সুইস ফ্রাঁর বিনিময় মূল্য ৯৫ টাকা ধরে)।
২০২০ সালে সেই দেশের ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ছিল ৫৬ কোটি ২৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ ২ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা বা ৫৫ শতাংশ বেড়েছে।
এ ছাড়া সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও দুবাইয়ে বাংলাদেশিরা এখন তারকা হোটেল ও স্থাপনার মালিক।ইউরোপ, আমেরিকাতেও বাড়ছে তাঁদের সম্পদ।যদিও এর কোনোটাই দেশ থেকে বৈধ উপায়ে যায়নি।এমন পরিস্থিতিতে সরকার বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ৭ শতাংশ কর দিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ দিয়েছে।