আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক লিমিটেডের মৌলভীবাজার শাখায় গ্রাহকেরা চাহিদা অনুযায়ী টাকা উত্তোলন করতে পারছেন না। গ্রাহকেরা বেশি পরিমাণে টাকা তুলতে চাইলেও শাখাটি ১০–২০ হাজারের বেশি দিতে পারছে না। প্রায় দেড়-দুই মাস ধরেই এমন পরিস্থিতি চলছে। এতে গ্রাহকদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। ব্যাংকে প্রতিদিনই আতঙ্কিত গ্রাহকদের ভিড় বাড়ছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে মৌলভীবাজার শহরের কোর্ট রোডের চৌমোহনা এলাকায় অবস্থিত আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের শাখায় গিয়ে দেখা যায়, বেশ কিছু গ্রাহক টাকা তুলতে এসেছেন। তাঁদের কেউ কেউ কর্মকর্তাদের সামনের চেয়ারে বসে আছেন, কেউ কেউ ক্যাশ কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আছেন। উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা নিয়ে তাঁদের কেউ কেউ জানতে চান, টাকা পাবেন কি না, পেলে কত পাবেন। বেলা ১১টা পর্যন্ত গ্রাহকদের এই শাখায় থাকা টাকা থেকে কিছু কিছু করে দেওয়া হয়েছে। কর্মকর্তারা গ্রাহকদের আশ্বাস দিয়ে বলেন, কাউকেই একেবারে খালি ফেরত দেওয়া হচ্ছে না। প্রধান কার্যালয় থেকে টাকা পাওয়া সাপেক্ষে বেশি করে দেওয়া হবে।
আলাপকালে কয়েকজন গ্রাহক প্রথম আলোকে জানান, তাঁরা দীর্ঘদিন ধরেই আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের এই শাখায় লেনদেন করছেন। তাঁদের অনেকের আত্মীয়স্বজন বিদেশ থেকেও এই ব্যাংকে টাকা পাঠিয়ে থাকেন।
সেলিনা বেগম নামের এক গ্রাহক প্রথম আলোকে বলেন, ‘১০ বছর ধরে এই ব্যাংকে লেনদেন কররাম (করতেছি)। এত দিন কোনো সমস্যা হয়নি। আমার অ্যাকাউন্টে টাকা আছে। আমি চাইছি ২০ হাজার, দেওয়া অর (হচ্ছে) ১০ হাজার। তারা (ব্যাংক কর্তৃপক্ষ) টাকা দিতে পারের (পারছে) না। ব্যাংকে টাকা নাই।’ তিনি গত রোজার সময় থেকে এ রকম সমস্যায় পড়ছেন বলে জানান।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার শেরপুরের দুধু মিয়া বলেন, ‘৫০ হাজার টাকা তুলতাম আইছি (তুলতে এসেছি)। এখন তারা ১০–২০ হাজার যা দেইন (দেন)। একবারে যে টাকা দেরা না (দিচ্ছে না), এমন না। আগে ভালা (ভালো) লেনদেন অইছে (হয়েছে)। রোজা থাকি (থেকে) সমস্যা। আমরা আটকি গেছি (আটকে গিয়েছি)। জিন্দেগিতেও (জীবনেও) এ রকম অইছে না (হয়নি)।’ তিনি জানান, চাহিদামতো টাকা তুলতে না পারায় ছেলে–মেয়ের পড়ালেখার খরচ দেওয়াসহ বিভিন্ন কাজ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।
মাওলানা আবুল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘৫০ হাজার টাকা তুলতে আইছি (এসেছি)। এখনো (সকাল ১১টা) কত দিবা, (দিবেন) তাদের সাথে কথা অয়নি (হয়নি), এখন যা দেইন (দেন)।’
উপস্থিত গ্রাহকদের পরে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেও জানা গেছে, রোজার কিছুটা আগে থেকে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের এই শাখায় নগদ টাকার সংকট চলছে। যেসব গ্রাহক ৫০ হাজার বা ১ লাখ টাকা তুলতে চাইছেন, তাঁদের কাউকে ১০ হাজার, আবার কাউকে ২০ হাজার টাকা দেওয়া হচ্ছে। বেশ কিছুদিন ধরেই এভাবে চলায় গ্রাহকদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। অনেকেই আতঙ্কে টাকা তুলতে ভিড় করছেন। সাধারণত যেখানে প্রতিদিন ৪০–৫০ জন গ্রাহক টাকা তুলতে আসতেন, সেখানে এখন ১০০–১৫০ জন আসছেন। কেউ কেউ টাকা কবে তুলতে পারবেন, সেই খোঁজ নিতে ব্যাংকে আসেন। এই শাখায় বর্তমানে চার শতাধিক গ্রাহক রয়েছেন বলে কর্মকর্তারা জানান।
মৌলভীবাজার প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও ছড়াকার আবদুল হামিদ মাহবুব গত মঙ্গলবার তাঁর ফেসবুক আইডিতে লিখেন, ‘আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের মৌলভীবাজার শাখায় গিয়েছিলাম টাকা ওঠাতে। ব্যাংক থেকে বলল ক্যাশ–সংকট, টাকা দিতে পারবে না। উপস্থিত গ্রাহকেরা জানালেন, দুই মাস ধরে এই ব্যাংক টাকা দিচ্ছে না। ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বললেন, “আমাদের কিছুই করণীয় নাই। যত পারেন, বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকই আমাদের এ অবস্থার মধ্যে ফেলেছে।”’ গতকাল তাঁর সঙ্গে ব্যাংকে প্রথম আলোর এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি বলেন, ‘আমি মঙ্গলবার ৫৫ হাজার টাকা চেয়েছিলাম। আজকে (বৃহস্পতিবার) ২০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।’
লিটন মিয়া নামের একজন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংকে আসলে (এলে) টেকা (টাকা) মিলে না। কালকেও (বুধবার) আইছি একবার। ব্ল্যাংক চেক দিয়া গেছি।’
গ্রাহক বিষ্ণু দে বলেন, ‘আমি এক মাস ধরে আসছি। প্রায় দিনই ধরনা দিই। সপ্তাহে একেক দিন ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা দিচ্ছে।’
নাসিমা বেগম নামের আরেকজন বলেন, ‘রমজানের আগে থেকে সপ্তাহে ১ দিন, ২ দিন ১০ হাজার টাকা করে দেয়। আস্তে আস্তে টাকা প্রায় তুলে ফেলেছি। এখন অল্প কিছু আছে।’
আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের মৌলভীবাজার শাখার ব্যবস্থাপক দেলওয়ার হোসেন গতকাল বলেন, ‘ফান্ড ক্রাইসিস আছে। সবাইকে চাহিদামতো টাকা দিতে না পারায় রিউমার ছড়িয়েছে। এখন সবাই টাকা তুলতে চাইছেন। এতে সংকট বেড়েছে। হেড অফিসে আলাপ হয়েছে। টাকা পাঠাচ্ছে। যা আছে, তা থেকে একটু একটু করে দিচ্ছি।’
আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের কোম্পানি সচিব রবিউল আলম উজ্জ্বল গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কিছু নগদ টাকার সংকটে পড়েছি। এটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। এ মাসের মধ্যে সমস্যা কেটে যাবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’