সম্মেলনের দ্বিতীয় এক অধিবেশনে উঠে এল ব্যাংক খাতে সুশাসনের ঘাটতির কথা। বক্তারা বললেন, খেলাপি ঋণ আসলে ক্যানসার।
দেশে গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা।
প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরও বেশি।
ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা ও খেলাপি ঋণ কমাতে ব্যাংকগুলোতে আরও বেশি স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ করা দরকার। তবে স্বতন্ত্র পরিচালককে প্রকৃতপক্ষে স্বতন্ত্র হতে হবে। ব্যাংকের নিয়ন্ত্রকদের ভাই, মামাতো ভাই অথবা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাকে স্বতন্ত্র পরিচালক মনোনয়ন দিলে কোনো লাভ হবে না।
বাংলাদেশ ব্যবসা সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে গতকাল রোববার এক অর্থায়ন নিয়ে এক অধিবেশনে বক্তারা এসব কথা বলেন। তাঁরা আরও বলেন, খেলাপি ঋণ ক্যানসারের মতো। এটা স্বল্প সময়ে না কমলে মৃত্যু নিশ্চিত। খেলাপি ঋণের কারণে সবাই (শেয়ারধারী, আমানতকারী) টাকা হারাচ্ছেন।
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে তিন দিনের এই সম্মেলন হচ্ছে। গতকাল এতে অনেকগুলো অধিবেশনের একটির শিরোনাম ছিল ‘দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন’। এতে সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান। প্রধান অতিথি ছিলেন বর্তমান গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) সম্মেলনটির আয়োজন করেছে।
খেলাপি ঋণকে গোপন করলে কোনো উপকার হবে না, সমাধান হবে না।আলী রেজা ইফতেখার, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইস্টার্ণ ব্যাংক
সম্মেলনে ব্যাংক খাতে সুশাসন ও খেলাপি ঋণ নিয়ে আলোচনা শুরু করেন ইস্টার্ণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার। সঞ্চালকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশের ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যাংকগুলোতে সুশাসনের অভাব রয়েছে। পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনার কার কী দায়িত্ব, তা নির্ধারিত হলেও অনেকে মানছে না। এ জন্য নির্দেশমতো ঋণ হচ্ছে, যা পরবর্তী সময়ে খেলাপি হয়ে পড়ছে।
এ সময় সঞ্চালক আতিউর রহমান বলেন, আরও বেশি স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিলে কি এই সমস্যার সমাধান হতে পারে?
এর জবাবে আলী রেজা ইফতেখার বলেন, এটা সমাধান হতে পারে। তবে সত্যিকার স্বতন্ত্র হতে হবে। কারও মামাতো ভাই বা কোম্পানির কোনো ব্যক্তির ভাইকে স্বতন্ত্র পরিচালক করলে হবে না।
আলী রেজা ইফতেখার আরও বলেন, খেলাপি ঋণকে গোপন করলে কোনো উপকার হবে না, সমাধান হবে না।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারও বলেন, ‘আমাদের এখানে স্বল্পমেয়াদি আমানত নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ হয়েছে। এতে দায় ও সম্পদের অসামঞ্জস্য তৈরি হয়েছে। এ জন্য খেলাপি ঋণ বাড়ছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, দেশে গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা। তবে প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরও বেশি।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, স্বতন্ত্র পরিচালকেরা স্বাধীনচেতা ব্যক্তি হলে এবং ব্যাংকের পর্ষদে তাঁদের সংখ্যা বেশি হলে ভূমিকা রাখা সম্ভব হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) স্বাধীনচেতা পেশাদার ব্যক্তিদের স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে মনোনয়ন দিতে পারে। তিনি বলেন, দক্ষদের আনতে স্বতন্ত্র পরিচালকদের সম্মানীর পরিমাণও বাড়াতে হবে। স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে একজন পেশাদার ব্যক্তি বোর্ড সভায় সারা দিন সময় ও শ্রম ব্যয় করে মাত্র সাত হাজার টাকা পান। এটা অত্যন্ত কম।
স্বতন্ত্র পরিচালকদের ব্যাংকে শেয়ার থাকে না। তাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয় সাধারণ আমানতকারীদের স্বার্থ সুরক্ষার জন্য। তবে বাংলাদেশে দেখা যায়, আত্মীয় ও ঘনিষ্ঠদের স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিচ্ছে পারিবারিক নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যাংকগুলো। স্বতন্ত্র পরিচালক ও প্রতিনিধি পরিচালক যেসব ব্যাংকের বেশি, সেই ব্যাংকগুলোতে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম ও দুর্নীতি হচ্ছে। কারণ, সুবিধা নেওয়া ছাড়া এসব পরিচালক কোনো ভূমিকা রাখছেন না।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) অডিটরিয়ামে ‘এথিকস ইন ব্যাংকিং’ শীর্ষক বক্তৃতায় গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান এ কে এম সাইফুল মজিদ গত শনিবার বলেন, অস্বাস্থ্যকর করপোরেট সংস্কৃতির কারণে গত চার দশকে আর্থিক খাতের পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ব্যাংকারদের লোভী মানসিকতার কারণে বেসিক ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি হয়েছে, যা আমানতকারী ও জনগণের মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতিকে প্রকট করেছে।
প্রসঙ্গত, এই চার ব্যাংকই পরিচালিত হচ্ছে প্রতিনিধি ও স্বতন্ত্র পরিচালক দিয়ে। মালিকেরা আড়ালে রয়ে গেছেন, তবে ঠিকই অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করেছেন।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, স্বতন্ত্র পরিচালকদের ভূমিকাকে সামনে আনা গোড়ার সমস্যা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার মতো। ব্যাংকে বোর্ড পেশাদার হলে স্বতন্ত্র পরিচালকদের ভূমিকা রাখার সুযোগ থাকে। পরিবারের আধিপত্য থাকলে সেটা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ব্যাংকের সমস্যা হলো বোর্ডের জবাবদিহি নেই। খেলাপি ঋণের মতো কুশাসনের সূচকগুলো বাড়তে থাকলে জবাবদিহি নিশ্চিতের দায়িত্ব নিয়ন্ত্রক সংস্থার।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক ভূমিকা রাখতে পারছে কি না, জানতে চাইলে জাহিদ হোসেন বলেন, রেগুলেটর (নিয়ন্ত্রক) তো এখন রেগুলেটেড (নিয়ন্ত্রিত)।
অধিবেশনে শান্তা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ভাইস চেয়ারম্যান আরিফ খান বলেন, ‘২০৪০ সাল পর্যন্ত আমাদের যে বিনিয়োগের লক্ষ্য রয়েছে, তাতে ১০ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি হবে। এখন পর্যন্ত বিনিয়োগের ৯৯ শতাংশই ব্যাংক থেকে হয়েছে। স্বল্পমেয়াদি আমানত নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিয়েছে ব্যাংক। এতে ব্যাংকগুলোর দায় ও সম্পদের মধ্যে অসামঞ্জস্য তৈরি হয়েছে। সম্পদের মান খারাপ হয়ে পড়েছে।’
অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম বলেন, ইতিমধ্যে শেয়ারবাজারে বেশ কিছু সংস্কার হয়েছে, যা বাজার সম্প্রসারণ ও উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। সরকারি বন্ড বাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। প্রয়োজন শেয়ারবাজারের জন্য করকাঠামো সংস্কার করা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, মূলধন জোগান দিতে সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে নিয়মকানুনগুলো আরও পর্যালোচনা করতে হবে। শেয়ারবাজার উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংক সব ধরনের নীতি সহায়তা দেবে।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি, বিনিময় হার ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে একটা চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি এ থেকে বের হয়ে আসার।’
অধিবেশনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি, ডলারের বিনিময় হার ও সুদহার নিয়ে কাজ করছে। চাহিদা কমিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে। বিনিময় হার হবে বাজারভিত্তিক ও এক। আর ঋণের সুদহার ইতিমধ্যে বাড়ানো হয়েছে। বাজারভিত্তিক সুদহার নির্ধারণ করে একটা করিডর প্রথা চালু করা হবে।’
প্রসঙ্গত, সুদহার ৯ শতাংশ নির্দিষ্ট করে রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ভোক্তাঋণের সুদহার ১২ শতাংশ। ডলারের দামও ভিন্ন কৌশলে আটকে রাখা হয়েছে। বাজারে ডলারের বিভিন্ন বিনিময় মূল্য চালু রয়েছে। এখন প্রবাসী আয়ে ডলারের দাম ১০৭ টাকা, রপ্তানি ও অন্যান্য আয়ে ১০৪ টাকা। আমদানিতে ডলারের দাম পড়ছে প্রায় ১০৬ টাকা। আর বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে ১০২ টাকা দামে।
অধিবেশনে ব্রুমার অ্যান্ড পার্টনার্স বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক খালিদ কাদীর বলেন, বাংলাদেশে অনেক পণ্য উৎপাদন হয়, সস্তা শ্রমিকও রয়েছে। তাই বাংলাদেশ এখনো বিনিয়োগের কেন্দ্র। বিশ্বের বিভিন্ন বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি ও পরিবারের কাছে বিনিয়োগ করার মতো আট লাখ কোটি ডলার রয়েছে। আমরা এদিকে নজর না দিয়ে এখনো অর্থায়নের জন্য বিশ্বব্যাংক, আইডিবির মতো সংস্থার দিকে ছুটছি।
এইচএসবিসি বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাহবুব উর রহমান বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দেশে বিনিয়োগ করলে তাঁদের ফিরে যাওয়ার পথও সহজ করতে হবে।
ব্যবসা সম্মেলনে গতকাল জ্বালানি, অবকাঠামো, কৃষি, ভোগ্যপণ্য, ডিজিটাল অর্থনীতিসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হয়। আজ সোমবার সরকারি–বেসরকারি অংশীদারত্ব, স্বাস্থ্য খাত, গাড়ি নির্মাণ, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ বিভিন্ন খাত নিয়ে অধিবেশন রয়েছে।