দেশে এখনো মার্কিন ডলার ও স্থানীয় টাকার সংকট চলছে, বৈদেশিক রিজার্ভ নিয়েও টানাটানি রয়েছে। তবে ডলারের দামে ছাড় দেওয়ায় প্রবাসী আয় বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যতম কাজ হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে মানুষকে স্বস্তিতে রাখা। কিন্তু ১৫ মাস ধরে দেশে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। এ জন্য মার্কিন ডলারের মূল্যবৃদ্ধিসহ বৈশ্বিক পরিস্থিতিকে দায়ী করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত জানুয়ারিতে ঘোষিত মুদ্রানীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জুন নাগাদ যেসব লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল, তার মধ্যে অনেকগুলোই অর্জন সম্ভব হয়েছে। তবে লক্ষ্যের চেয়ে অস্বাভাবিক বেশি টাকা ছাপানো ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির কারণে প্রায় লক্ষ্যচ্যুত হয়ে পড়েছে মুদ্রানীতি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্প্রতি প্রকাশিত জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের মুদ্রানীতি পর্যালোচনায় এ তথ্য পাওয়া গেছে। দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতির জন্য অতিরিক্ত টাকা ছাপানোকে দায়ী করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
জানুয়ারিতে ঘোষিত মুদ্রানীতিতে গত জুনের মধ্যে প্রকৃত বৈদেশিক সম্পদ ২ দশমিক ৪ শতাংশ ঋণাত্মক হবে বলে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু জুনের শেষে তা ১৭ শতাংশ ঋণাত্মক হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, রিজার্ভ থেকে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে ডলার বিক্রি করায় এই পরিস্থিতি হয়েছে।
এদিকে গত জুন পর্যন্ত লক্ষ্য ছিল রিজার্ভ মানি বা ছাপানো টাকায় প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশ ঋণাত্মক হবে। অথচ জুনের শেষে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৯ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেওয়া বন্ধ করলেও সংকটে থাকা ইসলামি ধারার কয়েকটি ব্যাংককে ঠিকই টাকা ছাপিয়ে ধার দিয়ে চলেছে। জুনের শেষ দিনেও প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয় কয়েকটি ব্যাংককে। এতে জুন শেষে রিজার্ভ মানিতে অস্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি হয়।
এ নিয়ে দেশের দুজন অর্থনীতিবিদের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর এই প্রতিবেদকের। তাঁরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলতে রাজি হন। এর মধ্যে একজন শুধু বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যেটা কাজ, সেটা করছে না। সরকারকে টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেওয়া বন্ধ করেছে। বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে তৎপর সংস্থাটি। কেন একটি গোষ্ঠীর ব্যাংকগুলোর জন্য এত টাকা ছাপাতে গেল। আর রিজার্ভ থেকে বিক্রি করা ডলার কি কোনো কাজে ব্যবহার হচ্ছে, নাকি এই ডলার বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে—তা পরিষ্কার করা উচিত।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশ রাখার ঘোষণা দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু গত জুনে অর্থবছরের শেষে গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। এ জন্য ডলার বিক্রির মাধ্যমে বাজার থেকে টাকা উত্তোলনের পাশাপাশি সরকারকে টাকা ছাপিয়ে ধার দেওয়া বন্ধ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এদিকে দেশে এখনো মার্কিন ডলারের পাশাপাশি স্থানীয় টাকারও সংকট চলছে, রিজার্ভ নিয়েও টানাটানি রয়েছে। তবে ডলারের দামে ছাড় দেওয়ায় প্রবাসী আয় বাড়ছে। রপ্তানি হিসাবে গরমিলের তথ্য ঠিক করায় লেনদেনের ভারসাম্যে চলতি হিসাব ঘাটতিতে চলে গেছে। তবে আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত হয়েছে। ব্যাংক খাত এখনো নিয়ন্ত্রণহীন। মোটাদাগে এসবই হচ্ছে এখন দেশের আর্থিক খাতের প্রধান সমস্যা। এসব সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। তারা বছরে দুবার মুদ্রানীতি ঘোষণার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা রক্ষার চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু বাস্তবে কোনো ফল আসছে না। আগে সংবাদ সম্মেলন ডেকে ব্যর্থতা ও সফলতা তুলে ধরলেও এবার তা করেনি নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। ফলে সংস্থাটির ব্যর্থতার ব্যাখ্যা জানা যাচ্ছে না।
১৮ জুলাই ওয়েবসাইটে দেওয়া মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ, যা গত জুন পর্যন্ত একই ছিল। তবে সরকারি খাতের ঋণের লক্ষ্য ১৪ দশমিক ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হলেও গত জুন পর্যন্ত তা ছিল ১২ দশমিক ৮ শতাংশ। এ জন্য আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ ঋণের মোট প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে ১০ দশমিক ৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুনে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে শরিয়াহভিত্তিক পাঁচ ব্যাংক ও প্রচলিত ধারার কয়েকটি ব্যাংককে ধার দেয়। এতে জুনে রিজার্ভ মানির (ছাপানো টাকা) প্রবৃদ্ধি হয় ৭ দশমিক ৯ শতাংশ, যা আগামী ডিসেম্বরে কমিয়ে ২ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। যদিও গত জুন পর্যন্ত রিজার্ভ মানির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ছিল ঋণাত্মক ১ শতাংশ। নতুন মুদ্রানীতিতে প্রকৃত বৈদেশিক সম্পদের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ, গত জুনে যা ছিল ২ দশমিক ৩ শতাংশ। মুদ্রানীতিতে এ বিষয়ে বলা হয়েছে, অফশোর ব্যাংকিং ও বিদেশফেরতদের বৈদেশিক মুদ্রার হিসাব খোলা ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধির ফলে বিনিময় হারের ওপর চাপ কমবে ও রিজার্ভ বাড়বে।
নতুন মুদ্রানীতিতে প্রতিটি মার্কিন ডলারের দাম ১১৭ টাকায় রাখার ঘোষণা দিয়ে ভবিষ্যতে তা বাজারভিত্তিক করার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ শিথিল করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়, এখন থেকে গাড়ি, ফলমূল, ফুল ও প্রসাধনী আমদানির ক্ষেত্রে শুধু ঋণপত্রের বিপরীতে নগদ অর্থ জমা দিতে হবে। এর বাইরে অন্যান্য পণ্য আমদানিতে অগ্রিম অর্থ জমার বিষয়টি শিথিল করা হবে।