দেশের মানুষের সঞ্চয় কমছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির অনুপাতে মোট জাতীয় সঞ্চয় দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ; আগের অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবছরে যা ছিল ৩০ দশমিক ৭৯ শতাংশ। সেই হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে সঞ্চয় কমেছে ৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
একই সময়ে, অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপির অনুপাতে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়ও কমেছে। সেই অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়ের পরিমাণ ছিল জিডিপির ২১ দশমিক ৫৬ শতাংশ, আগের অর্থ বছরে যা ছিল ২৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ। অর্থাৎ এক অর্থবছরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হারে সঞ্চয় কমেছে।
একই সময়ে দেশে বিনিয়োগ বেড়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে জিডিপির ৩১ দশমিক ৬৮ শতাংশ, আগের অর্থবছরে যা ছিল ৩১ দশমিক ০২ শতাংশ। সব মিলিয়ে চলতি মূল্যে বিনিয়োগ ও অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়ের ব্যবধান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ১২ শতাংশ; আগের অর্থবছরে যা ছিল ৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
বিনিয়োগ বৃদ্ধির হার উল্লেখযোগ্য না হলেও সঞ্চয় হ্রাসের ধারা দেখে বোঝা যায়, বিনিয়োগের বিপরীতে কাঙ্ক্ষিত কর্মসংস্থান হয়নি এবং মজুরিও মূল্যস্ফীতির সঙ্গে একই হারে বাড়েনি।
বাস্তবতা হলো, করোনার অভিঘাতে ২০২০ সালে অনেক মানুষের আয় কমে গিয়েছিল। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতেই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। বেড়ে যায় জ্বালানি তেলের দাম। এ কারণে গত বছরজুড়েই ছিল উচ্চ মূল্যস্ফীতি। কিন্তু তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে মানুষের আয় বাড়েনি; বরং মজুরি বৃদ্ধির হার বেশির ভাগ সময়ই ছিল মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম। এ ছাড়া ব্যাংক আমানতের সুদহারও মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম। মানুষের ভরসার জায়গা ছিল সঞ্চয়পত্র, কিন্তু তার সদুও দফায় দফায় কমানো হয়েছে। এতে আনুষ্ঠানিক খাতে সঞ্চয় কমছে। অনানুষ্ঠানিক খাতের হিসাব কারও কাছে নেই।
গত ২০২১-২২ অর্থবছরে সঞ্চয় কমার কারণ হিসেবে বিশ্লেষকেরা বলেন, মূলত কোভিড মোকাবিলায় দফায় দফায় যেভাবে বিধিনিষেধ দেওয়া হয়েছে, তাতে মানুষের আয় কমেছে। সেই সঙ্গে ২০২১ সালের বিধিনিষেধের সময় সরকারি-বেসরকারি সাহায্য-সহযোগিতা কমে যায়। মানুষের সঞ্চয় কমে যাওয়ার সেটাও একটা কারণ। এরপর ২০২১ সালের শেষ দিক থেকে মূল্যস্ফীতি বাড়তে শুরু করে। বাড়ানো হয় জ্বালানির দামও। ২০২২ সালের শুরুতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম আরও বেড়ে যায়। এ কারণে আগের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই নতুন ধাক্কা খায় মানুষ। এ সবকিছুর সম্মিলিত ফল হিসেবে মানুষের সঞ্চয় কমেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
এ প্রসঙ্গে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, এক সময় অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় বিনিয়োগের চেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু এখন সেটা কমে গেছে। তিনি মনে করেন, ২০২০- ২১ সালে করোনা ও ২০২২ সালের শুরুতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ শুরু হওয়ায় মানুষ সঞ্চয় ভাঙতে বাধ্য হচ্ছে। মানুষের জীবনযাপন কঠিন হচ্ছে। সামষ্টিক অর্থনীতিতেও এর প্রভাব পড়বে বলে তিনি মনে করেন। সেলিম রায়হান বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ ছাড়া মূলত মানুষের সঞ্চয়ই বিনিয়োগের প্রধান উৎস। সে জন্য সঞ্চয় কমে গেলে ভবিষ্যতে বিনিয়োগযোগ্য অর্থের ঘাটতি হতে পারে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে মোট ৩৪ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। অথচ একই সময়ে সঞ্চয়পত্র ভাঙানো হয়েছে ৩৬ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকার। এর মধ্যে শুধু গত নভেম্বর মাসে ৬ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা বিক্রির বিপরীতে ভাঙানো হয় ৭ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। মূলত, গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে সঞ্চয়পত্র কেনার চেয়ে ভাঙানো বেড়েছে। সরকারের নানা ধরনের বিধিনিষেধের কারণেও সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে। সেই সঙ্গে নতুন প্রবণতা হিসেবে দেখা যাচ্ছে সঞ্চয়পত্র ভাঙার ধারা। অর্থাৎ মানুষের আয়ে টান পড়েছে।
সেলিম রায়হান বলেন, দেশে মূল্যস্ফীতি এখনো ৮ শতাংশের ঘরে। সেই সঙ্গে বিশ্বজুড়ে এ বছর মন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে ২০২২–২৩ অর্থ বছরেও সঞ্চয় কমবে বলে তিনি আশঙ্কা করছেন।