মরক্কোর মারাকেশে গত সপ্তাহে যখন বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সপ্তাহব্যাপী বার্ষিক বৈঠক শুরু হলো, ঠিক তার আগেই মধ্যপ্রাচ্যে নতুন সংঘাত শুরু হয়। এর মধ্যেই গতকাল শনিবার এই দুই সংস্থার বার্ষিক এ বৈঠক শেষ হলো।
রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, এবারের বৈঠকে যেসব বিষয় বেশি আলোচিত হয়েছে, তার মধ্যে আছে বিশ্ব অর্থনীতিতে ক্রমবর্ধমান ঋণের বোঝা, মূল্যস্ফীতি আর দরিদ্র ও ধনী দেশগুলোর মধ্যে ক্রমবর্ধমান সম্পদবৈষম্য। সেই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো সংকট মোকাবিলায় ভেস্তে যেতে বসা নানা উদ্যোগ নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
বার্ষিক বৈঠকের সময় সাধারণ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পূর্বাভাস প্রকাশ করে আইএমএফ। এটা তাদের বহুদিনের রীতি। এবারও সেই রীতি মেনে তারা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পূর্বাভাস প্রকাশ করেছে। তবে ইসরায়েলে হামাসের হামলা শুরুর আগেই এই প্রতিবেদনের মূল কাজ হয়ে গেছে।
আইমএফের পূর্বাভাস, চলতি বছর বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হবে ৩ শতাংশ; আগের বছর যা ছিল ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। এরপর আগামী বছর, অর্থাৎ ২০২৪ সালে প্রবৃদ্ধি হবে ২ দশমিক ৯ শতাংশ; আগের পূর্বাভাসের চেয়ে যা শূন্য দশমিক ১ শতাংশ কম।
বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতির হারও কমছে। চলতি বছর বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে আসবে; আগামী বছর যা কমে দাঁড়াতে পারে ৫ দশমিক ৮ শতাংশে।
পরিস্থিতি ঠিকঠাক থাকলে বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুদহার বাড়ানোর ধারায় ছেদ টানতে প্রস্তুত রয়েছে। তাদের আশা, লাগামহীন মূল্যস্ফীতির রাশ শেষ পর্যন্ত হয়তো টানা যাবে এবং এ কাজ করার ক্ষেত্রে অর্থনীতিকে খুব বেশি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে না।
তবে হামাস-ইসরায়েলের সংঘাতে বিশ্ব অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়বে, তা বলার সময় এখনো না এলেও অধিকাংশ মানুষই আইএমএফের প্রধান অর্থনীতিবিদের কথার সঙ্গে একমত; সেটা হলো, বিশ্ব অর্থনীতি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে, দৌড়াচ্ছে না।
বিশ্বের উন্নত অর্থনীতি, যেমন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে চীন ও ইতালির ঋণের বোঝা বাড়ছে। বিষয়টি নিয়ে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বার্ষিক বৈঠকে বারবার আলোচনা হয়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বন্ডের সুদহার বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। ইতালির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ইগনাজিও ভিসকো বলেছেন, এমন ধারণা তৈরি হয়েছে যে বাজারে ‘টার্ম প্রিমিয়াম পুনর্মূল্যায়ন হচ্ছে’। বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘ মেয়াদি ঋণ ধরে রাখার বিষয়ে কিছুটা বিচলিত।
ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ধাক্কা আসতে পারে। আইএমএফের রাজস্ব বিভাগের প্রধান ভিক্টর গ্যাসপার এ কথা বলেন। তাঁর সতর্কবাণী, বর্তমানে যে ভর্তুকিভিত্তিক মডেল দিয়ে কার্বন নিঃসরণের নিট জিরো লক্ষ্যমাত্রা যেমন অর্জন করা যাচ্ছে না, তেমনি এই মডেলের ঋণের বোঝা আরও বাড়বে। তাঁর মত, কার্বন প্রাইসিং বা কার্বন নিঃসরণের দাম নির্ধারণ করে দেশগুলোকে নতুন নীতি প্রণয়ন করতে হবে।
উন্নত দেশগুলোর বাইরে উন্নয়নশীল দেশগুলো এখন যেসব সমস্যা বা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে, সেগুলো হলো, উচ্চ নীতি সুদহার, ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি ও ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তা।
তুরস্কের ক্ষেত্রে আলোচনা হয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ে। কেনিয়া ঋণের দুর্গতির হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, আগামী জুনে মেয়াদোত্তীর্ণ হতে যাওয়া ২০ কোটি ডলার ঋণের এক–চতুর্থাংশ বাই ব্যাক করতে চায়।
সেটা হলে দেশটির ঋণের বোঝা অনেকটাই কমবে। জাম্বিয়ার ঋণ পুনর্গঠন হচ্ছে; দেশটি চীন, ফ্রান্সসহ অন্য আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের ঋণ পুনর্গঠনে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছে।
তবে শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে কতটা অগ্রগতি হয়েছে, তা পরিষ্কার নয়। গত বৃহস্পতিবার শ্রীলঙ্কা জানিয়েছে, তারা চীনের এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংকের সঙ্গে ৪২০ কোটি ডলারের ঋণ পুনর্গঠন করেছে। সেই সঙ্গে অন্যান্য ঋণদাতার সঙ্গেও তাদের আলোচনা চলছে।
বিশ্বজুড়ে উচ্চ নীতি সুদহারের কারণে ঋণ নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। আইএমএফের বৈশ্বিক আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নীতি সুদহার আরও কিছুদিন বেশি ধরে উঁচু মাত্রায় থাকলে বিশ্বের অন্তত ৫ শতাংশ ব্যাংক চাপের মুখে থাকবে। এ ছাড়া বিশ্ব অর্থনীতি দীর্ঘ মেয়াদে নিম্ন প্রবৃদ্ধি ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির যুগে প্রবেশ করলে বিশ্বের আরও অন্তত ৩০ শতাংশ ব্যাংক চাপের মুখে পড়বে।
তবে এবারের বৈঠকে রীতিমাফিক একটি কাজ হয়নি। সেটা হলো, বৈঠক শেষে দুই সংস্থার যৌথ ঘোষণা। নানা ধরনের অনিশ্চয়তার কারণে বড় ধরনের ঐকমত্য না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ঘোষণা ছড়াই শেষ হয়েছে এবারের বৈঠক।