আইএমএফের ঋণ পেতে ব্যাংক খাত সংস্কারের অঙ্গীকার করেছে বাংলাদেশ। তবে পরিস্থিতির উন্নতির জন্য জোরালো সংস্কার প্রয়োজন।
গত এক যুগে অর্থনীতিতে বিশেষজ্ঞরা সবচেয়ে বেশি সুপারিশ করেছেন ব্যাংক খাত নিয়ে। সব মহল থেকেই ব্যাংক খাত সংস্কারে একটি কমিশন গঠনের দাবি তোলা হয়েছে বারবার। এ সময়ের দুই অর্থমন্ত্রীই একাধিকবার ব্যাংক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, পরে প্রতিশ্রুতি ভেঙেছেনও। আবারও ব্যাংক সংস্কারের অঙ্গীকার করেছেন বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল। তবে এই অঙ্গীকার করা হয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে, ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ পেতে।
প্রায় দুই দশক ধরে অর্থনীতিতে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) বড় প্রবৃদ্ধি হলেও ব্যাংক খাতের অবস্থা হয়েছে অনেক বেশি নাজুক। এ সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি ছিল দুর্বল। ঘটেছে একের পর এক ঋণ কেলেঙ্কারি, বেড়েছে খেলাপি ঋণ, ঋণখেলাপিদের ছাড় দিতে নিয়মনীতি শিথিল করা হয়েছে, প্রভাবশালীদের চাপে আইনে পরিবর্তন আনা হয়েছে, পরিবারতন্ত্র কায়েম হয়েছে, প্রতিষ্ঠা পেয়েছে একচেটিয়া মালিকানা, ব্যাংকের সম্পদ কমেছে, ব্যাংক খাতের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন প্রভাবশালী ও স্বার্থান্বেষীরা আর সবশেষে ভালো থাকা ইসলামি ব্যাংকগুলো পড়ে গেছে আর্থিক সংকটে।
এ রকম এক পরিস্থিতিতে আইএমএফের ঋণের শর্ত পালনের অংশ হিসেবে ব্যাংক খাতে সংস্কারের কথা বলছে বাংলাদেশ। কী ধরনের সংস্কার করা হবে, তা এখনো প্রকাশ করা হয়নি। তবে আলোচনা পর্যায়ে এ নিয়ে বেশ কিছু পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। যেমন খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি গঠন, ঋণখেলাপির সংজ্ঞায় পরিবর্তন, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ প্রায় ২১ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা, সরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে আমলাদের আধিক্য কমানো ইত্যাদি। তবে অনেকেরই প্রশ্ন—এসব ব্যবস্থা নিলেই কি ব্যাংক খাত ভালো হয়ে যাবে, হবে সব সমস্যার সমাধান? এ নিয়ে সংশয় প্রায় সব মহলেরই।
বাংলাদেশে ব্যাংক খাত সংস্কারপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে। তবে মূল সংস্কার হয় ১৯৯০-এর পর থেকে। সে সময় ব্যাংক কোম্পানি আইন গঠন করা হয়, খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়, ব্যাংকের মূলধন পুনর্গঠন করা হয়। দেশে প্রথম খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৯৮৯ সালে, আর সংজ্ঞাটি আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সমন্বয় করে পূর্ণাঙ্গ করা হয় ১৯৯৪ সালে। এরপর নানা সময়ে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তন করা হয়েছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঋণখেলাপিদের সুবিধা দিতেই এ কাজ করা হয়েছে।
বিশ্বব্যাংক বলেছে, বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ জানা যায় না। কারণ, খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা শিথিল করায় প্রকৃত অর্থ আড়ালে চলে গেছে। যেমন আন্তর্জাতিক মান যেখানে ৯০ দিন অনাদায়ি থাকলেই ঋণ খেলাপি হয়, বাংলাদেশে তা ১৮০ দিন। কেবল যে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা শিথিল করা হয়েছে তা নয়, উদারভাবে খেলাপি ঋণ পুনর্গঠনেরও সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
আইএমএফ এখন রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ অর্ধেক কমিয়ে আনতে বলেছে। এটা দুইভাবে সরকার করতে পারবে। যেমন ২ শতাংশ সুদে বা এ ধরনের নতুন কোনো নিয়ম করে আবারও ঋণ তফসিল করার সুযোগ কিংবা ঋণ অবলোপনের নিয়ম আরও শিথিল। কিন্তু তাতে ব্যাংক খাতের পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে না। সুতরাং পরিস্থিতির উন্নতির জন্য খেলাপিদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে হবে, কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে, খেলাপি ঋণের সংজ্ঞাও আন্তর্জাতিক মানের করতে হবে এবং নানা অজুহাতে বারবার ঋণ পুনঃ তফসিল করার বিশেষ সুযোগ বন্ধ করতে হবে।
প্রয়াত সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ২০২০ সালে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিশেষ একটি ঘটনার কথা বলেছিলেন। যেমন বেসরকারি খাতের এক ব্যাংকে এক পরিবার থেকে পাঁচজন পরিচালক ছিলেন। যদিও আইন ছিল এক পরিবার থেকে দুজনের বেশি পরিচালক থাকা যাবে না। তখন নিয়ম পালন করতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু সেই ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠির জবাবই দেয়নি। বরং তারা উচ্চ মহলে তদবির শুরু করে। এরপরই সরকার আইন পরিবর্তন করে এক পরিবার থেকে চারজন পরিচালক থাকার সুযোগ করে দেয়। সেই ব্যাংকটি ছিল ন্যাশনাল ব্যাংক। ২০১৭ সালে তখন আরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে পরিচালকেরা ব্যাংকে থাকতে পারবেন একটানা ৯ বছর।
মূলত প্রভাবশালী কয়েকজন ব্যবসায়ীকে সুযোগ দিতেই ব্যাংক কোম্পানি আইনে এ সংশোধন আনা হয়। এর মাধ্যমে ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র কায়েম হয় এবং একেকটি পরিবারের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে ব্যাংক। সুতরাং বেসরকারি খাতের ব্যাংক পরিস্থিতির উন্নতি করতে হলে আইনটি আবার সংশোধন করে পরিবারতন্ত্র ভেঙে দিতে হবে বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
শুরুটা হয়েছিল ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি। ওই দিন দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি খাতের ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকের মালিকানায় বদল ঘটে। মূলত শেয়ারবাজার থেকে শেয়ার কিনে এই পরিবর্তন ঘটানো হয়। এ ক্ষেত্রে সরকারেরও পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। একইভাবে পরবর্তী সময়ে মালিকানা বদল হয় সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে (এসআইবিএল)। বর্তমানে দেশের একটি বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের মালিকানায় আছে সাতটি ব্যাংক। এভাবে মালিকানা বদলের ঘটনা ঘটেছে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও। এ বিষয়ে অন্যতম একটি আলোচিত নাম হচ্ছে প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার। সব মিলিয়ে চারটি প্রতিষ্ঠানের মালিকানা ছিল তাঁর হাতে। ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ আত্মসাৎ করে এখন তিনি ভারতের জেলে।
একটি গোষ্ঠীর মালিকানায় থাকা ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধেও ঋণ বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এসব ব্যাংক আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ক্ষেত্রেও সংস্কার দরকার। বিশেষ করে প্রতিযোগিতা বজায় রাখতে একচেটিয়া মালিকানার অবসান ঘটাতে হবে। তা না হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।
বিশ্বব্যাংকও গত বছরের শেষে এক বিশেষ প্রতিবেদনে বেসরকারি ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ লেনদেন বন্ধের সুপারিশ করেছে। এ ছাড়া ঋণের আসল গন্তব্য কোথায়, কে উপকারভোগী, একজনের হাতে কয়টি ব্যাংকের মালিকানা থাকতে পারবে, নিজের ব্যাংক কত ঋণ নিতে পারবে, তা সুনির্দিষ্ট করার কথাও বলেছে। এসবই ব্যাংক খাত সংস্কারের অংশ বলেই বিশ্বব্যাংক উল্লেখ করেছে।
ব্যাংক খাতের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্তিশালী করার বিকল্প নেই বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি তাদের নজরদারির ক্ষমতাও বাড়াতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থাকতে অর্থ মন্ত্রণালয়ে আলাদা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রয়োজন নেই বলেও অনেক দিন ধরে ব্যাংক–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলে আসছেন।
বাংলাদেশে এখন ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি। প্রথম দিকে নতুন ব্যাংক দেওয়ার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বিবেচনা থাকলেও পরে রাজনৈতিক বিবেচনায়ই প্রাধান্য পেয়েছে। এর অনেকগুলোই দুর্বল ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, এ রকম ব্যাংকের সংখ্যা ১০টি। বহু বছর ধরেই দুর্বল ব্যাংক অন্য একটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার পরামর্শও দেওয়া হচ্ছে। সরকার এ জন্য আইন করার কথা বললেও বাস্তবে কিছুই হয়নি। এতে সামগ্রিক ব্যাংক খাতের ওপরেই নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ অবস্থায় সংস্কারের অংশ হিসেবে নতুন করে ব্যাংক না দেওয়া এবং দুর্বল ব্যাংক একীভূত করা প্রয়োজন বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। পাশাপাশি সরকারি ব্যাংকে কারা পরিচালক হবেন, সুদের বাজারব্যবস্থার ওপর ছেড়ে দেওয়া, ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের চিহ্নিত করার নীতিমালা তৈরি এবং আর্থিক কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি দেওয়া না হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না বলেও মনে করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সব মিলিয়ে ব্যাংক খাতে বড় ধরনের সংস্কারের প্রয়োজনের কথা সবাই মানেন। আর এ জন্য সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও সদিচ্ছার প্রয়োজন। আর তা না লে আইএমএফকে দেখানোর জন্য কিছু সহজ সংস্কার হবে ঠিকই, তাতে ব্যাংক খাতের তেমন কোনো উন্নতি হবে না।