ঋণ অনিয়ম

পণ্য আনতে ঋণে উদার ইসলামীসহ তিন ব্যাংক, আমদানি যৎসামান্য

নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর পর্যাপ্ত জোগান নিশ্চিত করতে নাবিল গ্রুপসহ ৮ প্রতিষ্ঠানকে ৬ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক। সুদসহ এখন যা বেড়ে হয়েছে ৭ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। আর সোশ্যাল ইসলামী ও ফাস্ট৴ সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ছাড় করেছে আরও ৫০০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ দেওয়া হয় ৭ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা। এসব ঋণের বড় অংশই দেওয়া হয়েছিল খাদ্যপণ্য আমদানির জন্য।

আট প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নেওয়া হলেও মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠান চলতি বছর ৮৬৪ কোটি টাকার ভুট্টা, সয়াবিনের বীজ, শর্ষের বীজ ও মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো যে পরিমাণ ঋণ নিয়েছে, তার মাত্র ১১ শতাংশ খরচ করেছে আমদানিতে। দেশের বিভিন্ন কাস্টম হাউস সূত্রে প্রাপ্ত আমদানিপণ্যের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এই তথ্য পাওয়া গেছে। তাই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, ঋণের এত টাকা গেল কোথায়?

সাম্প্রতিক সময়ে আমদানি-রপ্তানি ও হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার বাংলাদেশে বহুল আলোচিত বিষয়। যেভাবে নতুন কোম্পানিকে ইসলামী ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংক থেকে দ্রুত অর্থ ছাড় করা হয়েছে, তাতে এসব ঋণের ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোতে ‘ইসলামী ব্যাংকে ভয়ংকর নভেম্বর’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে তিন ব্যাংক থেকে আট প্রতিষ্ঠানকে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার  তথ্য তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়েছে ৭ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। আর চলতি মাসের ১ থেকে ১৭ নভেম্বর নেওয়া হয় ২ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। ভুয়া ঠিকানা ও কাগুজে দুই কোম্পানি খুলে ইসলামী ব্যাংক থেকে নেওয়া হয়েছে দুই হাজার কোটি টাকার ঋণ।

আমদানি অর্থায়নে ব্যাংক টাকা ছাড় করার অর্থ হলো, পণ্য দেশে এসে গেছে। এখন যদি সেই পণ্য দেশে না আসে, তাহলে বুঝতে হবে, অর্থ বাইরে চলে গেছে
সালেহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক গভর্নর

ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর ইসলামী ব্যাংক এক ব্যাখ্যায় বলে, ‘সাম্প্রতিক সময়ে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর পর্যাপ্ত জোগান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এ ধরনের পণ্য আমদানিতে ইসলামী ব্যাংক ঋণ বাড়িয়েছে। যথাযথ মূল্যায়নের পর পর্যাপ্ত জামানত গ্রহণ ও ব্যাংকের নিয়ম মেনেই ঋণ দেওয়া হয়েছে।’

সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া আটটি প্রতিষ্ঠান কত পণ্য আমদানি করেছে, তার তথ্য সংগ্রহ করা হয়। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান তেমন কোনো পণ্যই আমদানি করেনি।

জানতে চাইলে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব প্রতিষ্ঠানকে যে অর্থায়ন করা হয়েছে, তার বড় অংশই আমদানির জন্য। পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে খাদ্য কেনাকাটাসহ অন্য অর্থায়নও রয়েছে। আশা করছি, সময়মতো ঋণের টাকা ফেরত আসবে।’ কাগুজে নতুন কোম্পানিকে অর্থায়ন প্রসঙ্গে মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা বলেন, ‘সারা দেশে খাদ্য পরিবেশক হিসেবে কাজ করছে এমন যে কাউকে ইসলামী ব্যাংক অর্থায়ন করে থাকে।’

অর্থায়ন ও আমদানির চিত্র

সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের তালিকা ধরে ঋণ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর আমদানির তথ্য খুঁজে দেখা হয়েছে। তাতে নিত্যপণ্য আমদানির তালিকায় প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি। দুটি প্রতিষ্ঠান পণ্য আমদানি করলেও তা ছিল প্রাণিখাদ্য তৈরির কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি।
নাবিল ফিড মিলসকে ইসলামী ব্যাংক রাজশাহী শাখা গত ২৭ অক্টোবর ১৭০ কোটি টাকা অর্থায়ন করে। এ ছাড়া সোশ্যাল ইসলামী ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকও এ বছর প্রতিষ্ঠানটিকে অর্থায়ন করে। প্রতিষ্ঠানটি এ বছর ভুট্টা, শর্ষের বীজ, প্রাণিখাদ্য ও যন্ত্রপাতি মিলিয়ে এ বছর ৮৫৭ কোটি টাকার পণ্য আমদানি করেছে।

নাবা ফার্ম লিমিটেডকে ১৯ থেকে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত ৫ দফায় ৪৮৯ কোটি টাকা অর্থায়ন করে ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখা। এ অর্থায়নের পর এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ৩০ লাখ টাকার যন্ত্রপাতি আমদানি করেছে। এ বছর প্রতিষ্ঠানটি মোট আমদানি করেছে ৬ কোটি ৭১ লাখ টাকার। নাবিল ফিড মিলস ও নাবা ফার্মা মোট ৮৬৪ কোটি টাকার পণ্য আমদানি করে।

এসব নিয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে নাবিল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আমিনুল ইসলামকে ফোনে পাওয়া যায়নি। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর ঠিকানায় গিয়েও তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি।

অর্থায়ন হলেও পণ্য আসেনি

নাবিল গ্রেইন ক্রপসকে ইসলামী ব্যাংক ১ হাজার ১১ কোটি টাকা অর্থায়ন করলেও কোনো পণ্য আমদানি হয়নি। এ ছাড়া ব্যাংকটি ইন্টারন্যাশনাল প্রডাক্ট প্যালেসকে ৫৪৫ কোটি টাকা, মার্টস বিজনেস লিমিটেডকে ৯৮১ কোটি টাকা, নাবা এগ্রো ট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে ১ হাজার ২২৪ কোটি টাকা, আনোয়ারা ট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে ১ হাজার ৯০ কোটি টাকা, শিমুল এন্টারপ্রাইজকে ১ হাজার ৬৯৩ কোটি টাকার অর্থায়ন করে। এ অর্থায়নের বিপরীতে প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করেনি।

ব্যাংক থেকে নেওয়া এসব ঋণের মেয়াদ এক বছর। অর্থ ফেরত না এলে নিয়ম অনুযায়ী এক বছর পর এসব ঋণ খেলাপি হবে। তাই এসব ঋণের ভবিষ্যৎ কী তা বুঝতে অপেক্ষা করতে হবে এক বছর।

আমদানিকারকেরা জানান, পণ্য আমদানিতে অর্থায়নের জন্য গ্রাহকের হাতে পুরো অর্থ দেওয়া হয় না। ঋণপত্র খোলার পর ব্যাংকই রপ্তানিকারকের নির্ধারিত ব্যাংকে অর্থ পরিশোধ করে। প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে ঋণপত্র খুলে পণ্য আমদানিতে সময় লাগে এক থেকে দুই সপ্তাহ। এ ছাড়া অন্যান্য দেশ ভেদে এক থেকে দুই মাসের মধ্যে পণ্য আমদানি হয়। পণ্য দেশে আসার পরই সাধারণত ব্যাংক রপ্তানিকারকের ব্যাংকের অনুকূলে অর্থ ছাড় করে।

যে আটটি প্রতিষ্ঠানের নামে তিন ব্যাংকের অর্থ ছাড় করা হয়েছে, তার মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল প্রডাক্ট প্যালেস, নাবিল গ্রেইন ক্রপস, মার্টস বিজনেস লিমিটেডের নাম নাবিল গ্রুপের ওয়েবসাইটে নেই। তবে উল্লিখিত তিনটি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ব্যাংক তিনটির মালিকপক্ষ ও নাবিল গ্রুপের ব্যবসা একই ধরনের।

ব্যাংক তিনটির কর্মকর্তারা জানান, ঋণ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরা আমদানি না করে চট্টগ্রামের বড় এক আমদানিকারক থেকে পণ্য কিনেছে। এ জন্য ঋণের তুলনায় কম পণ্য আমদানি হয়েছে।

ডলার–সংকটের এ সময়ে  নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে পারছে না অনেক আমদানিকারক। তখন এই ব্যাংক তিনটি অন্য আমদানিকারক থেকে পণ্য কিনতে হাত খুলে অর্থায়ন করেছে। অনেক ক্ষেত্রে মানা হয়নি নিয়মকানুনও।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, আমদানি অর্থায়নে ব্যাংক টাকা ছাড় করার অর্থ হলো, পণ্য দেশে এসে গেছে। এখন যদি সেই পণ্য দেশে না আসে, তাহলে বুঝতে হবে অর্থ বাইরে চলে গেছে।

ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তন ভালো উদ্দেশ্যে করা হয়নি। এর ফল এখন পাওয়া যাচ্ছে, যা খুবই দুঃখজনক। সবচেয়ে বড় এ ব্যাংকটি সমস্যায় পড়লে দেশের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই এখনই সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে।