সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ আরও বাড়ানো হয়েছে। এখন নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি কী করে, সেটিই দেখার বিষয়।
বাংলাদেশ ব্যাংককে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে সরকারের মনোনীত পরিচালকদের অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এত দিন এই ক্ষমতা শুধু সরকারের হাতেই ছিল। আর বাংলাদেশ ব্যাংক শুধু পরিচালকদের আচরণ সম্পর্কে সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে পারত।
সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনে বেসরকারি ব্যাংকের মতো রাষ্ট্রমালিকানাধীন ও সরকারি ব্যাংকের পরিচালকদের অপসারণের ক্ষমতাও বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে দেওয়া হয়েছে। এতে এ ধরনের ব্যাংকের ওপর নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির তদারকির ক্ষমতা বেড়েছে। এর ফলে ব্যাংক খাতের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা আরও বাড়ল। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন এই আইন কতটা প্রয়োগ করে, সেটিই দেখার বিষয়।
এ নিয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা ভালো উদ্যোগ। তবে দেখতে হবে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই ক্ষমতা কতটুকু প্রয়োগ করে। শরিয়াহ ব্যাংকগুলো সবই বেসরকারি খাতের। এসব ব্যাংকেও এত অনিয়মের কথা শোনা গেল, কিন্তু কাউকে তো অপসারণ করতে শুনলাম না। অথচ এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে অসীম ক্ষমতা দেওয়া আছে। আমার সময়ে চেয়ারম্যান, এমডিদের অপসারণ করতে কোনো দ্বিধা করতাম না। কারও অনুমতি নেওয়া বা কারও সিদ্ধান্তের দিকে চেয়ে থাকার বিষয় ছিল না। এবার আইনে এই সুযোগ দিলেও সার্বিকভাবে সংশোধনী ভালো হয়নি। কারণ, পরিচালকদের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে, খেলাপিদের ঋণ নেওয়ার সুযোগও দেওয়া হয়েছে।’
জাতীয় সংসদে গত ২৬ জুন ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধনী পাস হয়। এতে পরিচালকদের মেয়াদ ৯ বছর থেকে বাড়িয়ে ১২ বছর করার পাশাপাশি খেলাপিদের ঋণ নেওয়ার সুযোগ প্রদানসহ নানা পরিবর্তন আনা হয়। সংশোধনীর ফলে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (বিডিবিএল) পাশাপাশি সরকারি খাতের বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি), রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) ও প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংকের পরিচালকদের অপসারণের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে বেসরকারি খাতের আইএফআইসি ব্যাংকের কয়েকজন পরিচালকের ক্ষেত্রেও এই ধারা প্রযোজ্য হবে। কারণ, আইএফআইসি ব্যাংকের ৩২ দশমিক ৭৫ শতাংশ শেয়ারের মালিক সরকার। শেয়ারের অনুপাতে ব্যাংকটিতে পরিচালক নিয়োগ দেয় সরকার।
আগের ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালকবৃন্দ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আমানতকারীদের জন্য ক্ষতিকর বা নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট লেনদেনের মাধ্যমে ব্যাংকের তহবিলের অপব্যবহার বা অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন করলে তা প্রতিরোধে তাঁদের অপসারণ করতে পারত বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে সরকার কর্তৃক মনোনীত বা নিযুক্ত চেয়ারম্যান ও পরিচালকের ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রযোজ্য ছিল না।২০১৩ সালে আইন সংশোধনের সময় যুক্ত করা হয়, সরকার কর্তৃক মনোনীত বা নিযুক্ত ব্যাংক পরিচালকদের আচরণ সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিবেদন পেশ করলে সরকার তা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করবে।
গত মাসে সংসদে সংশোধিত ব্যাংককোম্পানি আইনে অনিয়মের ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি নির্বিশেষে সব ব্যাংকের পরিচালক অপসারণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে পুরো ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক প্রথম আলোকে বলেন, আইনের এই পরিবর্তন সরকারি ব্যাংকগুলোতে সুশাসন নিশ্চিতে আরও ভূমিকা রাখা যাবে। সরকারি ব্যাংকের পরিচালকেরাও জবাবদিহির আওতায় আসবেন, যা পুরো ব্যাংক খাতের জন্য ভালো হবে।
প্রসঙ্গত, সরকারি খাতের বেশির ভাগ ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিযুক্ত সমন্বয়ক ও পর্যবেক্ষকেরা কাজ করছেন।
আগের ব্যাংক কোম্পানি আইনে বলা হয়েছিল, সরকার কর্তৃক মনোনীত বা নিযুক্ত ব্যাংক পরিচালকদের আচরণ সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের কাছে প্রতিবেদন পেশ করলে সরকার তা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করবে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুপারিশ শোনেনি। যেমন বেসিক ব্যাংকে অনিয়ম শুরু হলে বাংলাদেশ ব্যাংক একাধিকবার তা তুলে ধরে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান, পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) ভূমিকা সম্পর্কে সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। কিন্তু সেই প্রতিবেদন আমলে না নিয়ে উল্টো শেখ আব্দুল হাই ওরফে বাচ্চুকে দ্বিতীয় দফায় ব্যাংকটির চেয়ারম্যান করা হয়। এরপর আরও প্রতিবেদন পাঠালে মেয়াদ শেষের আগের দিন তাঁকে অপসারণ না করে পদত্যাগের সুযোগ করে দেওয়া হয়। তৎকালীন অর্থমন্ত্রীর ঢাকার ইস্কাটনের বাসায় গিয়ে শেখ আব্দুল হাই পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছিলেন। সেই ঘটনার ৯ বছর পর গত জুনে এসে তাঁকে আসামি করে অভিযোগপত্র দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে ওই সময় ব্যাংকটির এমডি কাজী ফখরুল ইসলামকে অপসারণ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
এদিকে অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক এমডি সৈয়দ আব্দুল হামিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিবেদন পাঠালেও সরকার তা শোনেনি। উল্টো আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সৈয়দ আব্দুল হামিদের মেয়াদ বাড়িয়ে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। আইন লঙ্ঘন করে দেওয়া মেয়াদ বাড়ানোর চিঠিতে লেখা হয়, ‘পরবর্তী এক বছরের জন্য অগ্রণী ব্যাংকের এমডি পদে সৈয়দ আবদুল হামিদের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাবে সম্মতি দেওয়া হলো। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন গ্রহণের প্রয়োজন নেই।’ অথচ ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া এমডির নিয়োগ ও মেয়াদ বৃদ্ধির সুযোগ নেই।
আবার জনতা ব্যাংকের সাবেক এমডি আব্দুছ ছালাম আজাদের বিরুদ্ধে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একাধিক প্রতিবেদন জমা দিলেও তাঁকে বারবার মেয়াদ বাড়িয়ে ৬৫ বছর পর্যন্ত পদে থাকার সুযোগ দেওয়া হয়। অথচ তাঁর মেয়াদে ব্যাংকটি সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়ে। একসময় ভালো ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ব্যাংকটি এখনো ঝুঁকছে। অ্যাননটেক্স ও ক্রিসেন্টের কাছে জনতা ব্যাংকের প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা আটকে গেছে। এ রকম বড় কয়েকটি গ্রুপের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে ব্যাংকটি।
ব্যাংকগুলোতে সরকার সাধারণত যাঁদের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়, তাঁদের বেশির ভাগই সাবেক আমলা। অবশ্য বর্তমান আমলারাও পরিচালক হিসেবে বিভিন্ন ব্যাংকে সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে আছেন। তবে কয়েক বছর ধরে পেশাদার হিসাববিদ, সাবেক ব্যাংকার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাবেক বিচারকদেরও পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যাঁরা পর্ষদে ভালো ভূমিকা রাখতে পারছেন। এদিকে সাবেক ও বর্তমান আমলাদের বেশির ভাগই সভায় হাজিরা দিয়ে ভাতা ও পরিবহনসুবিধা নেওয়া ছাড়া তেমন ভূমিকা রাখেন না বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তারা।
আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক কমিটির সহসম্পাদক কে এম এন মনজুরুল হক ওরফে লাবলু গোপালগঞ্জ-১ আসন থেকে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। তবে মনোনয়ন লাভে ব্যর্থ হন। এরপর ২০১৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান সাবেক এই ছাত্রলীগ নেতা। এর আগেও তিনি অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অর্থ ও পরিকল্পনা উপকমিটির সহসম্পাদক রাজীব পারভেজ ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পটুয়াখালী-১ আসন থেকে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। ২০২০ সালের ২২ মার্চ তাঁকে রাষ্ট্রমালিকানাধীন বেসিক ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার। এরপর আবার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। পরিচালক বানানোর সময় তাঁর পরিচয় দেওয়া হয় ‘গভর্নেন্স পলিসি এক্সপ্লোর সেন্টার’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক।
ব্যাংক পরিচালকেরা প্রতিটি সভায় অংশ নেওয়ার জন্য ৮ হাজার টাকা ভাতা পান। তবে কর কেটে নেওয়ার পর হাতে পান ৭ হাজার ২০০ টাকা। কোনো কোনো ব্যাংক মাসে চারটি সভাও করে থাকে। ব্যাংকের পর্ষদের পাশাপাশি পরিচালকেরা বিভিন্ন কমিটিরও সদস্য হিসেবে থাকেন। এসব কমিটির সভায় অংশ নেওয়ার জন্যও বাড়তি টাকা দেওয়া হয়।